(প্রথম অংশ প্রকাশের পর দ্বিতীয় অংশ)
প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ময়মনসিংহের সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেক মতপার্থক্য দেখা দেয়। রেনেলের মানচিত্র ঘাটলে দেখা যায় আড়াই শত বছর আগে মোমেনসিং এবং আলাপসিং পরগনার সীমানা ঘেঁষে সাগরের মতো ব্রহ্মপুত্র নদের অথৈ পানি ছুটে চলতো এপার থেকে ওপার পনের বিশ কিলো জুড়ে। সে সময়ে ব্রহ্মপুত্র অতিক্রম করতে ৫/৬ ঘন্টায় সময় লাগত।,,,
রেনেলের মানচিত্রে আলাপসিং ও মোমেনসিং পরগনায় অংকিত অতি প্রাচীন গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহঃ
জেমস রেনেল অংকিত মানচিত্র বাংলার প্রাচীন মানচিত্র। মানচিত্রগুলো ছিলো একসময় দুষ্প্রাপ্য। দেখা যাচ্ছে, প্রথম বাংলার মানচিত্র আঁকেন মেজর জেমস রেনেল। তিনি একজন ব্রিটিশ ভূবিদ, ভূগোলবিদ, নৌ-প্রকৌশলী, ঐতিহাসিক এবং মহাসমুদ্রবিদ্যার জনক। রেনেলের দেখা আলাপসিং ও মোমেনসিং পরগনা এখন বদলে গেছে ৯৫ ভাগ। ১৭৬৪ সালের শুরুর দিকে বাংলার বিস্তীণর্ অঞ্চলের জরিপ কাজ সম্পন্ন করে মানচিত্র তৈরির কাজ শুরু করেন। এই জেমস রেনেলই তো ফকির-সন্ন্যাসীদের দমন করতে গিয়ে তাদের হাতে বেদম মার খেয়েছিলেন। তখনও কিন্তু পৃথিবীর মানচিত্র একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে। উল্লেখ্য যে, ১৭৬৪ সাল থেকে ১৭৭৭ সাল পর্যন্ত এই তের বছর তিনি বঙ্গদেশের ব্রিটিশ জরিপকাজে নিযুক্ত ছিলেন। তার তৈরি মানচিত্র পরবর্তীতে প্রায় নির্ভুল প্রমাণিত হয়। তার কয়েকটি মানচিত্র সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করার মাধ্যমেই বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার নতুন ইতিহাস খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়েছে। অন্য সব প্রাচীন নৌবন্দরের মতো বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার অনেক স্থানের নামই তার মানচিত্রে দেখতে পাওযা যায় এবং রেনেলের সব মানচিত্রগুলো দেখলে ও গবেষণা করলেই তা ময়মনসিংহের প্রাচীন ইতিহাস সহজে বোঝা যাবে।
এখানে প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে স্থানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাচীনত্বের দাবি রাখে। তবে বলে রাখা ভাল, উচ্চারণগত পার্থক্যের কারণে স্থানগুলোর নাম রেনেলের মানচিত্রে কিছুটা পরিবর্তিত রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার আঞ্চলিক টানের কারণেও নামের বিকৃতি ঘটতে পারে। এমনও হতে পারে, রেনেলের মানচিত্রে পুরাতন স্থানগুলোর যে নাম ব্যবহার করা হয়েছে তা কালের পরিক্রমায় পরিবর্তিত হয়েছে। এমনি করে বর্তমান নামের সঙ্গে কিছুটা অমিল পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেমন বাইগনবাড়ি থেকে বেগুনবাড়ি। তবে যে কারণেই স্থানের নামগুলোর মধ্যে গড়মিল পরিলক্ষিত হোক না কেন, রেনেলের মানচিত্রে নির্দেশিত বর্ণনা এবং জায়গাগুলোর বর্তমান অবস্থান হুবহু মিলে যায়।
আর একটি কথা বলে নেয়া ভাল, রেনেলের এ মানচিত্র সহজেই অনুমান করা যায় যে, অংকিত জায়গাগুলো প্রাচীন জনপদ হিসেবে বর্তমান ময়মনসিংহ অঞ্চলের ইতিহাসকে দিনে দিনে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়েছে বহুগুণ। এসব প্রাচীন জায়গাগুলো আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। স্থানীয় হিস্টোরিক্যাল সোস্যাইটির মাধ্যমে রেনেলের মানচিত্রে বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার যেসব স্থানের নাম উল্লেখ আছে তার বিবরণ ও বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা করা হচ্ছে।
আলাপসিং পরগনায় রেনেলের মানচিত্র অনুযায়ী তৎকালীন নাসিরাবাদ শহরের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি তবে বাইগনবাড়ি নামে পুরাতন শহরে বৃহত্তর ময়মনসিংহের পাঁচ রাস্তার সংযোগস্থল, বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে বাইগনবাড়ি নদীর সংযোগস্থল, ঐতিহাসিক স্থান, বানিজ্য কেন্দ্র, নৌবন্দর হিসেবে এক সময়ে প্রসিদ্ধ ছিল। যদ্দুর মনে হয়, নাসিরাবাদ শহরের পূর্ব নাম বাইগনবাড়ি। উল্লেখ্য যে, আমেরিকায় অবস্থিত নিউইয়র্ক হিস্টোরিক্যাল সোস্যাইটি মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরিতে রয়েছে বিশ্বের মূল্যবান সব ডকুমেন্ট। তন্মধ্যে একটি ডকুমেন্ট ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত ’ A Description Of The Roads In Bengal And Bahar ’ নামে একটি বিখ্যাত বই যা সমগ্র বাংলা ও বিহারের রোড ম্যাপ ও নদী পথের দূরত্বের তালিকা রয়েছে। রেনেলের কয়েকটি মানচিত্রের মধ্যে একটি রোডম্যাপ A General Map of the Roads in Bengal And Bahar এই প্রাচীন বইটিতে রয়েছে যার মাধ্যমে ময়মনসিংহের গুরুত্বপূর্ন স্থানের প্রামাণিক ইতিহাস পাওয়া যাচ্ছে।
সংগৃহীত রেনেলের রোড ম্যাপটি ময়মনসিংহের ’ পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স-২০২০’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। রেনেলের অংকিত রোডম্যাপে ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রসিদ্ধ স্থানগুলো হচ্ছে-বাইগনবাড়ি (বেগুনবাড়ি), গোলাবাড়ি, বোকাইনগর, সেরপুর-১ (শেরপুর উপজেলা, বগুড়া), সেরপুর-২ (শেরপুর জেলা), সুসং, জঙ্গলবাড়ি, আজমেরী, সিলেট, সুজতপুর, দেওয়ানগঞ্জ, ঘোড়াঘাট, হোসনেবাদ, মধুপুর, আতিয়া, ভাওয়াল ইত্যাদি। এমনকি যে শহর নিয়ে এতো আলোচনা, সেই নাসিরাবাদ শহর নামেও কোনো স্থানের পরিচয় পাওয়া যায় না। তাছাড়া রেনেলের অংকিত আরেকটি পরগনাভিত্তিক মানচিত্রে দেখা যায়, পশ্চিম ময়মনসিংহের পরগনা ও প্রসিদ্ধ স্থানগুলো – আলাপসিং পরগনা, পুখুরিয়া পরগনা, কাগমারী পরগনা, জফরশাহী পরগনা, আতিয়া পরগনা, ভাওয়াল পরগনা ইত্যাদি; এখানে প্রাচীন শহর বাইগনবাড়ি, দেওয়ানগঞ্জ, এখানে প্রাচীন জনপদ, শেওড়া, মুক্তাগাছী, মধুপুর, রামচনপুর, কালীগঞ্জ, মালাঞ্চ, শ্যামগঞ্জ, মোহনগঞ্জ, নারায়ণপুর, মির্জাপুর, কাঞ্চনপুর ইত্যাদি।
পূর্ব ময়মনসিংহের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, মোমেনসিং পরগনা নিয়ে এত আলোচনা, সেই মোমেনসিং নামেও ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আংশিক অংশ, গৌরীপুর, তারাকান্দা, নেত্রকোনাসহ বিশাল অঞ্চল নিয়ে মোমেনসিং পরগনার পরিচয় পাওয়া যায়। মোমেনসিং পরগনার দক্ষিণে হোসেনশাহী পরগনা, উত্তরে সুসং, দশকাহনিয়া, শেরপুর পরগনা ইত্যাদি। দেখা যাচ্ছে প্রাচীন শহর বোকাইনগর, জঙ্গলবাড়ি, শিমুলকান্দি, রামপুর, দুর্গাপুর ইত্যাদি; এখানে প্রাচীন জনপদ, নৌবন্দর বা প্রসিদ্ধ স্থানের নাম সরিষাহাটি, পরানগঞ্জ, কাশেরগঞ্জ, মুদ্দেরগঞ্জ, রাঘবপুর, মধুপুর, হুগলা, তেলিগাতি, সোনাজুরি, মদন, খালিয়াজুরি, কান্দিউড়া, ইটনা, নিকলি, এগারসিন্দুর, মহিষপাড়া, বাজিতপুর, মিটামইন, সিংপুর, বাঁশাটি, পেচাংগিয়া, রঘুনাথপুর, মধ্যনগর, বাইগনবাড়ি কুঠি, রাজাগঞ্জ, নাটেরকোনা ইত্যাদি নিয়ে অনেক গবেষণা আছে।
মোমেনসিং পরগনা থেকে সৃষ্টি বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের নামকরণ:
’মোমেনসিং’ নামে জেলা পত্তনের সময়ে অথবা বাংলার উপ-প্রদেশ হিসেবে ’সরকার বাজুহা’র নাম পরিবর্তন করার সময় রেনেলের মানচিত্রে অংকিত ’মোমেনসিং’ পরগনা ইতিহাস-ঐতিহ্য, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, রাজকীয় দাপট, ভূমির পরিমাপ, রাজস্ব আদায়ের পরিমাপ ইত্যাদি অন্যান্য পরগনার চেয়ে অনেক বেশী ছিল। তাছাড়া, পশ্চিম ময়মনসিংহের তুলনায় পূর্ব ময়মনসিংহে জমিদারির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল। বিভিন্ন রাজদরবারে অর্থাৎ মুঘল দরবারে, নবাব দরবারে এবং ইংরেজ শাসনকালে বিভিন্ন আদালতে মোমেনসিং পরগনার নাম ব্যাপক আলোচিত এবং সুপরিচিত হয়েছিল।
উল্লেখ্য, ঈশা খাঁর তৃতীয় শক্তিধর, বারভূঁইয়ার নবাব সমতুল্য জমিদার, মুঘল আমলের ইতিহাসখ্যাত তিনটি বইয়ের উল্লেখিত বীরযোদ্ধা আফগান হিরো খাজা উসমান খাঁ উত্তর উড়িষ্যা থেকে গৌরীপুরের বোকাইনগরে আসেন। ১৬০৯ সালে খাজা উসমান খাঁ বোকাইনগর ত্যাগ করার পর অত্র পরগনার সব কিছু মুঘলদের অধীনে চলে যায়। এমনি করে, গৌরীপুরের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী মুর্শিদাবাদের দরবারে রাজস্ব বিভাগে প্রধান কর্মচারী ছিলেন এবং ক্রমশ কাননগো পদ লাভ করেন। নবাব দরবারে রাজস্ব বিভাগে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১৭১৭ সালে তিনি সেই সময়ের মোমেনসিং পরগণার বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী কেল্লা বোকাইনগর নিকটে অবস্থিত বাসাবাড়িতে কাচারি ও কাননগো অফিস নির্মাণ করেন। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র চাঁদরায় ছিলেন নবাব আলিবর্দী খাঁর খুবই আস্থাভাজন ও মোহনলাল এর মত বড় মাপের রাজ কর্মচারী ছিলেন। চাঁদ রায়ের উদ্যোগে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী জামালপুর জেলার অন্তর্গত জফরশাহী পরগনা লাভ করেন। ফলে তিনি দুই পরগনা (মোমেনসিং ও জফরশাহী) মিলে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ একর জমির অধিকারী হয়ে জনসমাজে বিশেষ খ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তখন মুক্তাগাছা জমিদার অধীনে আলাপসিং পরগনার তিন লক্ষ ছাব্বিশ হাজার একর জমি ছিল।
ইতিহাসের পাতা ঘাটলে দেখা যায়, শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানরা আগে থেকেই পৃথকভাবে বসবাস করতেন। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী ও তার জ্যেষ্ঠপুত্র চাঁদ রায়ের মৃত্যুর পর কৃষ্ণকিশোর, কৃষ্ণগোপাল, গঙ্গানারায়ণ ও লক্ষীনারায়ণ এই অবশিষ্ট চার ভাই সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হন। চার ভাইয়ের মধ্যে দু’টি তরফ গঠিত হয়েছিল- তরফ রায় হিস্যা ও তরফ চৌধুরী হিস্যা। এই দুই পরগনার জমিদার শ্রীকৃষ্ণ রায়চৌধুরীর তরফ রায় হিস্যার দুই পুত্র (কৃষ্ণকিশোর ও কৃষ্ণগোপাল) দত্তক নিয়েছিলেন মাধবী তথা আলেয়ার গর্ভজাত সিরাজপুত্রকে। নবাব সিরাজের পুত্রের নয়া নামকরণ হয় যুগলকিশোর রায় চৌধুরী। জামালপুর জেলার অন্তর্গত জফরশাহী পরগানার কৃষ্ণপুর এলাকায় তরফ রায় হিস্যার জমিদার বাড়িতে এবং মালাঞ্চ এলাকায় তরফ চৌধুরী হিস্যার জমিদার বাড়িতে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বংধররা বসবাস করতেছিল। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর সমস্ত সম্পত্তির অর্ধেক ও তরফ রায়ের উত্তরাধিকারসূত্রে জমিদারি পান যুগলকিশোর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে তিনি ছিলেন মহারাজ সমতুল্য জমিদার। ওই সময় মহারাজ সনদ দিলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অবশ্যই তিনি পদটি পেতেন। সে সময় জফরসাহি অঞ্চলে এক মহামারি দেখা দিলে যুগলকিশোর কৃষ্ণপুর থেকে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে আসেন। তখন তাকে মোমেনসিং পরগনার জমিদার বা রাজা বলা হতো। এ দিক থেকে দেখতে গেলে তখন গৌরীপুর, কালীপুর, রামগোপালপুর নামে কোন জমিদারি পত্তন হয়নি।
যুগলকিশোর রায় চৌধুরী অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং পরাক্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। বিষয়-বুদ্ধি, রাজনীতি, সমরনীতি প্রভৃতিতে তার মত প্রতিভাবান ও তেজস্বী পুরুষ সেইসময়ে অতি নগন্য ছিল। তার প্রতাপে ”বাঘে মহিষে এক ঘাটে জল খাইত”। জনগণ তাকে যমের মতো ভয় করত। তার অঙ্গুলি হেলানে সমগ্র পরগনা চলতো। ফকির সন্ন্যাসি মোমেনসিং পরগনায় ছিল না। তবে সিংধার জমিদার মুহম্মদ খাঁর সাথে তার শত্রুতা ছিল। নবাব আমল থেকে জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বংশধরদের প্রতি তার বিদ্বেষভাব ছিল। ময়মনসিংহে বন্যার পর তার প্রশ্রয়ে তার প্রজারা যুগলকিশোরের এলাকায় লুটপাট চালাতে থাকে। যুগলকিশোর এই লুটতরাজ দমন করতে চেয়ে ব্যর্থ হন। তিনি মুহাম্মদ খাঁ-কে ব্যবস্থা নিতে বললে তার অনুরোধে কর্ণপাত না করে তিনি অবজ্ঞার সাথে উত্তর পাঠান। যুগলকিশোর ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন।
সালটি ছিল ১৭৭৯। তিনি প্রায় পাঁচ হাজার লাঠিয়াল সৈন্য নিয়ে সিংধা পরগনায় আক্রমণ করেন। তার পদাতিক দলে লাঠি, বর্শা, সড়কি ও তরবারির আস্ফালন ছিল। তারা প্রতিশোধস্বরূপ সিংধায় প্রবেশ করে নির্বিচারে প্রজাদের সর্বস্ব লুন্ঠন করে ও তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। তখন ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন কালেক্টর রটন সাহেবের কাছে মুহাম্মদ খাঁ এ বিষয়ে নালিশ জানান। রটন সাহেব তদন্ত করে ঢাকায় রিপোর্ট পাঠান। তার এ পাশবিক অত্যাচারের জন্য ঢাকার কমিশনার ডবিøউ ডগলাস ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে রেভিনিউ বোর্ডের অনুমতিক্রমে রাজা যুগলকিশোর রায়ের সকল সম্পত্তি বাজোয়াপ্তপূর্বক তাকে ঢাকায় বিচারার্থে প্রেরণের জন্য ময়মনসিংহের কালেক্টরকে নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু কালেক্টর রটন সাহেব তার পক্ষাবলম্বন করায় তাকে ঢাকার পরিবর্তে ময়মনসিংহেই বিচার করা হয়। তাকে বিচারে জামিন দিয়ে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ইংরেজদের সাথে যুগলকিশোরের সুসম্পর্ক থাকায় মোমেনসিং পরগনার নাম দিয়েই মোমেনসিং জেলা সৃষ্টি হয়েছে।
ব্রিটিশ ভূবিদ জেমস রেনেলের মানচিত্র ও ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ইতিহাসের পাতা ঘাটলে দেখা যায়, মোমেনসিং নামটি প্রথমে পরগনা এবং পরে উপ-প্রদেশ ও জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজদের পেশা-পদবী, চিঠি, তারিখসহ অফিসিয়াল ডকুমেন্ট থেকে ময়মনসিংহের ইতিহাস আরও সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। যেমন, Board of Revenue Proceedings, 11th-18th April, 1788 : A letter from the Collector of Momensing : In the mean time I do myself, the honour to enclose an account of the Bazar prices of rice during the Pous and Maug Months of the Bengal year 1192, 1193 and 1194 in which it is useless to further remarks—. I am & W Wroughton, Collector— Momensing The 9th April 1788. ### Magistrate of Momensing, Mr. J. Straccy: 29th January.1802 ইত্যাদি।
ময়মনসিংহ জেলা পত্তনের আরেকটি কারণ ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। কেদারনাথ মজুমদারের মতে, ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে একদল সন্ন্যাসী আলাপসিংহ ও জফরসাহি পরগণায় প্রবেশ করে জমিদার ও প্রজার অর্জিত শস্য, ক্ষেত থেকে নিয়ে যায়। এর পর জমিদাররা ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি রেভিনিউ বোর্ডে এ বিষয়ে অভিযোগ করেন। পরে ১৪ ফেব্রæয়ারি রেভিনিউ বোর্ড হতে ঢাকার প্রধানের (Chief of Dacca) উপর সৈন্য প্রেরণের দায়িত্ব ও সাধ্যানুসারে সাহায্য করে জমিদারদের রক্ষার আদেশ জারি করা হয়। ঢাকার Chief জাফরসাহি পরগনায় সৈন্য প্রেরণ করেন। তখন সৈন্যরা বিপন্ন হয়ে ঢাকা প্রস্থান করেন। সন্ন্যাসীদের উলঙ্গ অত্যাচার খরস্রোতে প্রবাহিত হতে থাকে। মার্চ মাসে সন্ন্যাসীরা মালঞ্চার কাছারি লুণ্ঠন করেন। জমিদাররা পলায়ন করে গৌরীপুর উপজেরা অন্তর্গত বোকাইনগর বাসাবাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। দক্ষিণে মধুপুর জঙ্গল ও উত্তরে শেরপুরের বন-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা ফকির-সন্ন্যাসীদের দমন করার জন্যই জামালপুরে একটি শাসনকেন্দ্রের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ফকির-সন্ন্যাসীদের দমন করার জন্য ইংরেজরা জাফরসাহি পরগনার জামালপুর সদরে সেনানিবাস স্থাপন করেন।
শ্রী কেদারনাথ মুজমদার তার ’ময়মনসিংহের বিবরণ’ নামক প্রামাণ্য গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় ময়মনসিংহের প্রাচীন বিবরণ ও কারণ সম্বন্ধে বর্ণনা করেছেন। কামরূপ রাজ্য হতে স্বাধীন ভূখন্ড নছরৎ সাহের নামানুসারে অভিহিত হয়। তিনি বলেন- ”টোডরমল্লের বন্দোবস্ত কাগজে নছরৎসাহী “সরকার বাজুহা” নামে লিখিত হইয়াছে। ইংরেজ শাসনকালের প্রারম্ভে সরকার বাজুহা “জেলা মমিনসিংহ” নামে অভিহিত হইয়াছে। “ময়মনসিংহ” নামের কারণ ও ময়মনসিংহ নামটি “মমিনসাহীর” পরিবর্তিত সংস্করণ। কথিত আছে দিল্লিশ্বর আকবরসাহের সময়ে মমিনসাহ নামে কোন ব্যক্তি সরকার বাজুহার একাংশের অধীশ্বর ছিলেন। সেই মনিনসাহ হইতে তদীয় অধিকৃত (পরগনার) মহালের নাম মমিনসাহী (মোমেনসিং পরগনা) হইয়াাছিল। আই-ই-আকবরই গ্রন্থে মমিনসাহী মহালের নাম দেখা যায়। মৈমনসিংহ বা ময়মনসিংহ রাজস্বে (বৃহত্তর) জেলার সর্বপ্রধান পরগণা। পরগণা মমিনসাহী বা মৈমনসিংহের গভর্নমেন্ট রাজস্ব সর্বাপেক্ষা অধিক বলিয়া এই জেলা ময়মনসিংহ” নামে অভিহিত হইয়াছে। এই জেলা স্থাপন সময়ে ইহার আকার বর্তমান আকারের অর্থাৎ বৃহত্তর ময়মনসিংহের দ্বিগুণ ছিল। এই জেলা বর্তমান আয়তনেও ইংল্যান্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ জেলা ইয়র্কসায়ারের তুলনা অংশ বৃহত্তর।”
১৭৬৫ সালে দেওয়ানী গ্রহণের ফলে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল উপ-প্রদেশ হিসেবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণভুক্ত হয়। বাংলাদেশের প্রশাসনিক তাগিদ পূরণের উদ্দেশ্যে সারা দেশের মধ্যে মাত্র চার-পাঁচ জন জেলা কালেক্টর নিয়োগ করা হয়েছে। বৃটিশ আমলের প্রথম দিকে নোয়াখালী, রংপুর, ঢাকা ও মোমেনশাহী এই চারটি জেলা কালেক্টরেটের সাহায্যে বাংলাদেশের মতো একটি বিশাল দেশ শাসন করা হতো। পরবর্তীকালে বৃহত্তর ময়মনসিংহের সমস্ত অঞ্চল সমন্বয়ে মোমেনসিং পরগনার নামানুসারে মোমেনসিং (ময়মনসিংহ) জেলা বা প্রদেশ গঠিত হয়।
প্রসঙ্গক্রমে রাজা যুগলকিশোর রায়ের কথা উল্লেখ করা যায়। তার নেতৃত্বেই পরগনার নাম অনুসারে মোমেনসিং (ময়মনসিং) জেলা স্থাপিত হয়। তৎকালীন রামগোপালপুর জমিদার রাজা যোগেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী তার তৃতীয় পুত্র লেখক শৌরীন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ’ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাম্মণ জমিদার’ নামক প্রামণ্য গ্রন্থে জমিদারদের বংশ ও যুগলকিশোরের বিভিন্ন ঘটনার কাহিনী বর্ণনা করেছেন। যুগলকিশোর রায় এ জেলার একজন প্রধান জমিদার এবং বিশেষ গণনী ব্যক্তি। চলমান.. …