বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০২:৩৯ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ :
খুনী হাসনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বাংলার মাটিতেই তার বিচার করা হবে  —-সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স মাদককে লাল কার্ড দেখিয়ে  প্রার্থিতা ঘোষণা করলেন কবি সেলিম বালা খেতে বিষ প্রয়োগ!  ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাইয়ের অভিযোগ ! ১৭ ফেব্রুয়ারী সমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে নেত্রকোনায় জেলা বিএনপির প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত  ঈশ্বরগঞ্জের ইতিবৃত্ত ও অজানা কিছু ইতিহাস ( পর্ব-৩) নেত্রকোনায় কেন্দুয়ায় শিল্প বিপ্লব নিয়ে দুই শতাধিক তরুণের অংশ গ্রহণে ভাবনা উৎসব নেত্রকোনায় কেন্দুয়ায় ‘স্মরণে মননে হেলাল হাফিজ’ সাহিত্য আড্ডা অনুষ্ঠিত আটপাড়ায় অনিয়মের অভিযোগ দেখিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষককে বরখাস্ত নেত্রকোণা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য বিনামূল্যে বাস সার্ভিস চালু মদন চাঁনগাও ইউনিয়নে কৃষক দলের সমাবেশ অনুষ্ঠিত।

‘মোমেন’ থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ  আর বাইগনবাড়ি থেকে নাসিরাবাদ শহরের উৎপত্তি

মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার
  • আপডেটের সময় : শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২২
  • ৪৯৪ বার পড়া হয়েছে

(প্রথম ও দ্বিতীয় অংশ প্রকাশের পর তৃতীয় ও শেষ অংশ)

প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ময়মনসিংহের সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেক মতপার্থক্য দেখা দেয়। রেনেলের মানচিত্র ঘাটলে দেখা যায় আড়াই শত বছর আগে মোমেনসিং এবং আলাপসিং পরগনার সীমানা ঘেঁষে সাগরের মতো ব্রহ্মপুত্র নদের অথৈ পানি ছুটে চলতো এপার থেকে ওপার পনের বিশ কিলো জুড়ে। সে সময়ে ব্রহ্মপুত্র অতিক্রম করতে ৫/৬ ঘন্টায় সময় লাগত।,,,

আলাপসিং পরগনায় পশ্চিম ময়মনসিংহের প্রাচীন শহর বাইগনবাড়ি (বেগুনবাড়ি):

বাইগনবাড়ি ময়মনসিংহের একটি অন্যতম প্রাচীন নগর। প্রসিদ্ধ এই নগরী ইতিহাসে বাইগনবাড়ি নদী ও আদি (বিশাল) ব্রহ্মপুত্র নদের সংযোগস্থলে বাইগনবাড়ি শহর অবিভক্ত বাংলায় বেশ পরিচিত ছিল। একসময় বাইগনবাড়ি পশ্চিম ময়মনসিংহের রাজধানী এবং বোকাইনগর পূর্ব ময়মনসিংহের রাজধানী ছিল। রেনেলের মানচিত্রে বাইগনবাড়ি নামে একটি উপ-নদীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বাইগনবাড়ি নদীর সম্বন্ধে কেউ জানে না। তবে সুতিয়া নদী বেগুনবাড়ির সন্নিকটে ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিলেছে। এ থেকে জানা যায়, বেগুনবাড়ির আদি নাম বাইগনবাড়ি এবং সুতিয়া নদীর আদি নাম বাইগনবাড়ি নদী। তবে বর্তমান বেগুনবাড়ি এলাকাতে রেল স্টেশনের নাম বাইগনবাড়ি রেল স্টেশন হিসেবে এখনও বিদ্যমান।
ইতিহাস গবেষকরা মনে করেন, বাইগনবাড়ি নদীর নাম অনুসারে শহরের নাম হয়েছে বাইগনবাড়ি। এক সময়ে নদীর চরগুলিতে প্রচুর বেগুন চাষ হতো এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বেগুন (বাইগন) রপ্তানি করা হতো। তাই নদীর নাম বাইগনবাড়ি। আবার অন্যান্য গবেষকরা মতামত ব্যক্ত করেছেন যে, কামরূপ শাসন আমলে বাইগনবাড়ি নামকরণ করা হয়েছে। ওই সময়ে প্রসিদ্ধ স্থান হিসেবে জাত, ফলন ও প্রকৃতির নাম অনুসারে শহর, বন্দর, নগর ও রাজ্যের নাম দেওয়া হতো। যেমন জঙ্গলবাড়ি, বাসাবাড়ি (বাশেঁরবাড়ি), বড়ইবাড়ি, কমলাবাড়ি, রাজাবাড়ি, সরিষাবাড়ি, ভূটিয়ারবাড়ি, যাত্রাবাড়ি ইত্যাদি।
শেরপুর জেলার সীমানায় এবং আসাম প্রদেশে রেনেলের মানচিত্রে বাইগনবাড়ি কুঠি নামে আরও একটি জায়গার সন্ধান পাওয়া গেছে। ব্রিটিশ ভূবিদ জেমস রেনেলের মানচিত্রের বর্ণনায় বাইগনবাড়ির রোড ম্যাপের কথা উল্লেখ্য আছে। ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত বই  A Description Of The Roads In Bengal And Bahar  এবং  A General Map of the Roads in Bengal  ,১৭৭৮ কর্তৃক সংরক্ষিত বইটিতে মানচিত্রসহ গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের পাঁচটি সংযোগস্থল বা বাইগনবাড়ির ৫ রাস্তার মোড় পাওয়া গেছে। পূর্বে এ তথ্যের অভাবে সাধারণ মানুষের কাছে অজানাই থেকে গেছে এই ইতিহাসের কথা। বাইগনবাড়ির রোডম্যাপ ও ডাটা তথ্য দেখে বোঝা যায় বাইগনবাড়ি অতি প্রাচীন শহর। তাছাড়া জেমস রেনেলের বইয়ের মানচিত্রের বিবরণ থেকে পাওয়া যায় যে, কলকাতা থেকে পরানগঞ্জ পর্যন্ত নদী পথের দূরত্ব ৪৯৮ মাইল এবং বাইগনবাড়ি পর্যন্ত নদী পথের দূরত্ব ৪৯৪ মাইল।
আলাপসিং পরগনায় ইংরেজ আমলে নতুন শহরের পরিকল্পনা এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে নাসিরাবাদ নামকরণের ইতিহাস:

আলাপসিং পরগনায় নাসিরাবাদ  নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। ইংরেজ আমলে জেলার নামকরণে নাসিরাবাদ হয়নি। ঐতিহাসিক ঘটনাবলী থেকে জানা যায যে, ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে নাসিরাবাদ মোমেনসিং জেলার অন্তর্গত সদর টাউন হিসেবে পত্তন ঘটেছিল এবং টাউনের নাম পরিবর্তন হয়েছিল ১৯০৫ সালে। তখন নাম দেওয়া হয়েছিল ময়মনসিংহ জেলা শহর। আদিতে ’মোমেনসিং’ জেলা- ‘ মোমেন’ থেকে ‘ময়মন’ এবং ’সিং’ এর সাথে ’হ’ মিলে বর্তমান বাংলায় উচ্চরণ ’ময়মনসিংহ’ এবং ইংরেজিতে উচ্চরণ ’মাইমেনসিং’।এই সব উদাহরণ থেকে স্পষ্টই উপলদ্ধ হয় যে, ময়মনসিংহ জেলার নাম উচ্চরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইংরেজদের রাজনীতি ও জমিদার শিক্ষিত অভিজাত শ্রেণিসহ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ইতিহাস।
অধ্যাপক গোলাম সামদানী কোরায়শীর মতে, ময়মনসিংহকে বেসরকারীভাবে ’মোমেনশাহী’ লেখার প্রবণতা দেখা যায় বিভিন্ন ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এ  প্রবণতার একমাত্র উদ্দেশ্য ময়মনসিংহ জেলার বিকৃতিকে সংশোধন করা। ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজ জরিপকারী মেজর জেমস রেনেল তৎকালীন বাংলার যে মানচিত্র অংকন করেছিলেন তাতে বাইগনবাড়ির নামে এক বিখ্যাত শহর ছিল। ১৭৮৭ সালে বন্যা ও ভূমিকম্পে প্রাচীন বানিজ্য শহর বাইগনবাড়ির ৯০ ভাগ ধ্বংস হওয়ার পর ইংরেজরা নতুন শহর তৈরী করার জন্য জরিপ কাজ শুরু করেন। এ জরিপের তথ্য জানতে গিয়ে নাসিরাবাদ নামকরণের ইতিহাসের আরেকটি তথ্য কচ্চুয়া গোষ্ঠীর মাধ্যমে  বের হলো।
’কচ্চুয়া গোষ্ঠীর উৎস সন্ধান ও ক্রমবিকাশ’ এর তথ্যসূত্র অনুযায়ী আড়াইশ’ বছর আগে ময়মনসিংহ শহরে সম্ভবতঃ শেওড়া এলাকায় নাসির উদ্দিন মোড়ল নামে এক ব্যক্তি বাস করতেন। পৈত্রিকসূত্রে তিনি ১০০ একর অধিক জমির তালুকদার ছিলেন। তার ৮০ ভাগ জমি ছিল জঙ্গল এবং ২০ ভাগ ছিল আবাদী জমি ও চর। নাসির উদ্দিনের পিতা লস্কর মাহমুদ খুব সাহসী ও বীর ছিলেন। লস্কর মাহমুদ এক সময়ে জঙ্গলে কয়েক ঘন্টায় বন্য মহিষের সঙ্গে যুদ্ধ করে মহিষের শিং  ভেঙ্গে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাকে দেখার জন্য দেশ-দেশান্তর  থেকে অনেক লোক এসেছিল। লস্কর মাহমুদের ছেলে নাসির উদ্দিন তার বিশাল জমি দেখে ইংরেজরা নতুন শহর তৈরী করার পরিকল্পনা করেন। জরিপে দেখেন, বন-জঙ্গল থাকার কারণে জায়গাটা খুব উচু, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় খুবই উপযোগী। এখানে শহর তৈরি করলে টেকসই হবে। ইংরেজদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী  বেগুনবাড়ির কালেক্টর অফিসে নাসির উদ্দিন মোড়লকে ডাকা হয়। নতুন শহর তৈরি করার জন্য নাসির উদ্দিনের সমস্ত সম্পত্তি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্রয় করতে চায় এবং বিনিময়ে তাকে দ্বিগুন অর্থসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। প্রথম প্রস্তাবে তিনি রাজি হয়ে গেলেন। পরবর্তী সময়ে প্রতিবেশীর চাপ এবং পূর্ব পুরুষদের ভিটা, জমি ও কবরস্থান দেখিয়ে বিক্রি করার অস্বীকার জানান তিনি। এ বিষয় জানার পর ইংরেজরা খুব আশ্চর্যবোধ করেন। পরে বানিয়াদের সহযোগিতা নিয়ে ইংরেজরা শহরের নাম নাসিরাবাদ নামকরণ করে নাসির উদ্দিনের সমস্ত জমি ক্রয় করেন।
প্রচুর অর্থ পেয়ে নাসির উদ্দিন চারটি বিয়ে করে ১৮ জন স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী ছেলে ও এক মেয়ে জন্ম দিয়ে কচ্চুয়া গোষ্ঠীর গোড়াপত্তন শুরু করেন। ৩০ বছর পর নতুন শহরে নাসির উদ্দিনের ছেলেদের গুন্ডামি শুরু হয়। আদিপত্য বিস্তারের জন্য কোথাও মারামারি, এমনকি খুনও হয়। তাদের তান্ডবে নাসিরাবাদ শহর কম্পিত শুরু হল। এলাকার জমিদাররা নাসির উদ্দিনের তেজস্বী ছেলেদের বিরুদ্ধে কাহিনী বিবৃত করে অভিযোগ করেন। ইংরেজ প্রশাসন তদন্তের জন্য স্থানীয় প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। আদালতের সম্মুখে নাসির উদ্দিনের নাতিসহ ৬০ এর অধিক জনসংখ্যার বিস্তার এবং আত্মীয় স্বজনসহ ১০০ জনের অধিক উপস্থিতি দেখে ইংরেজরা বিচলিত হয়েছিলেন। তখন থেকে কচ্চুয়া গোষ্ঠীর নামকরণ হয়।
নাসির উদ্দিন মোড়লের বংশ বিস্তার এবং জমিদারদের সঙ্গে গোলযোগের আশঙ্কা দেখে তার তেজস্বী ছেলেদের ’মাইগ্রেট’ বা শহর থেকে তাড়ানোর জন্য ইংরেজরা একটি পরিকল্পনা তৈরী করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ইংরেজদের কর্তৃক প্রদত্ত অর্থ ও তাদের সম্পতির ভাগাভাগির অর্থ নিয়ে আসাম, সিলেট, চট্টগ্রাম, হালুয়াঘাট, তারাকান্দা (ধনিয়া কান্দা), গৌরীপুর, ঈশরগঞ্জ, ত্রিশাল (কানুর বাজার), ময়মনসিংহ সদরের ঘাগড়া ইউনিয়ন (পারুইল বাজার), চর নিনুক্ষীয়া ইউনিয়ন, বলাশপুর, দীঘারকান্দা, ফকিরাকান্দা, পালাকান্দি, শেওড়া, কৃষ্টপুর, পূরবী সিনেমা হল সংলগ্ন চামড়া গুদাম, আকুয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় নাসির উদ্দিনের ছেলে সন্তানরা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বর্তমান কচ্চুয়া গোষ্ঠীর জনসংখ্যা ১৫ হাজার অধিক।
কেবল কচ্চুয়া গোষ্ঠীর জনসংখ্যা তাদের পূর্ব পুরুষদের ইতিহাসের কথা জনশ্রæতির মাধ্যমে বহুদিন ধরে লালিত করে আসছেন। নাসিরাবাদ নামকরণের ইতিহাস বিকৃতি প্রতিহত করার জন্য এবং কচ্চুয়া গোষ্ঠীর জনসংখ্যা সুসংহত করার জন্য ময়মনসিংহের দিঘারকান্দায় একটি সংগঠন গড়ে উঠে। সংগঠনটির নাম ’কচ্চুয়া গোষ্ঠী জনকল্যাণ সংস্থা’। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘নাসিরাবাদ একটি অতীত ইতিহাস বিজড়িত শহর ছিল। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় এ পর্যন্ত নাসির উদ্দিন মোড়লের কথা আলোচনা আসেনি। এর পেছনে জমিদার আমলের সন্ধানী লেখকদের উন্নসিকতা ও তাচ্ছিল্যবোধ কাজ করেছে। তাছাড়া ইতিহাস বিকৃতি ও নামকরণ পরিবর্তন করার পেছনে জমিদাররা দায়ী। ইংরেজ শাসনামলে ষোড়শ শতাব্দীর বাংলার স্বাধীন সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তার পুত্র সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত শাহ’র নামে এখানে শহর তৈরী করা হয়েছিল তা প্রশ্নই আসে না। তা সম্ভব ছিল মুঘল বা নবাব আমলে। সঠিক ইতিহাস উপস্থাপন করার জন্য বর্তমান লেখকদের  প্রতি আহ্বান রইল। অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা রইলো ইতিহাস অনুসন্ধানী সংগঠন ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স।’ নাসির উদ্দিনের ইতিহাস এখানে থেমে গিয়েছিল। ছিল শুধু ধূসর স্মৃতি। সেই স্মৃতিকে ধরে রাখছে শুধু কচ্চুয়া গোষ্ঠী। বর্তমান সহযোগিতা করেছে ইতিহাস অনুসন্ধানী সংগঠনগুলো।
ময়মনসিংহের সাাম্প্রতিক ইতিহাস
সরকারি তথ্য বা উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, বর্তমান নাসিরাবাদ নামকরণের ইতিহাস হচ্ছে- মোগল আমলে মোমেনশাহ নামে একজন সাধক ছিলেন, তার নামেই মধ্যযুগে অঞ্চলটির নাম হয় মোমেনশাহী। ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার স্বাধীন সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তার পুত্র সৈয়দ নাসির উদ্দিন নসরত শাহ’র জন্য এ অঞ্চলে একটি নতুন রাজ্য গঠন করেছিলেন, সেই থেকেই নসরতশাহী বা নাসিরাবাদ নামের সৃষ্টি। নাসিরাবাদ নাম পরিবর্তন হয়ে ময়মনসিংহ হয় একটি ভুলের কারণে। বিশ টিন কেরোসিন বুক করা হয়েছিল বর্জনলাল এন্ড কোম্পানির পক্ষ থেকে নাসিরাবাদ রেল স্টেশনে। এই মাল চলে যায় রাজপুতনার নাসিরাবাদ রেল স্টেশনে। এ নিয়ে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পরবর্তীতে আরো কিছু বিভ্রান্তি ঘটায় রেলওয়ে স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে ময়মনসিংহ রাখা হয়। সেই থেকে নাসিরাবাদের পরিবর্তে ময়মনসিংহ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে বর্তমানে ইতিহাসের এই কথাগুলো দিয়ে পাঠক-পাঠিকার কাছে অন্ধকারে ঢিল মেরে অথবা গোঁজামিল দিয়ে ইতিহাস বোঝানো হয়েছে। কেননা এখানে ইতিহাসের কোন ধারাবাহিকতা নেই।
ময়মনসিংহের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা হচ্ছে ১) কামরূপ রাজ্য হতে একটি স্বাধীন ভূখন্ড এবং বিভিন্ন মহালে নামকরণ ২) নছরতের নতুন শাসিত প্রদেশ ”নছরত ও জিয়াল” বা নাসিরাবাদ ৩) নাসিরাবাদ পরিবর্তে ৩২টি মহাল নিয়ে ‘‘সরকার বাজুহা’’ গঠন ৪) সরকার বাজুহা এর পরিবর্তে বৃহত্তর মোমেনসিং বা মোমেনশাহী জেলা বা প্রদেশ পত্তন ৫) মোমেনসিং জেলার প্রধান নগর ’বাইগনবাড়ি’ ধ্বংস হওয়ার পর নতুন প্রধান জেলা শহর ’নাসিরাবাদ’ পত্তন ৬) ’নাসিরাবাদ’ এর পরিবর্তে জেলা শহর হিসেবে বহত্তর জেলা নামানুসারেই আজকের ’ময়মনসিংহ’ সদর এবং সিটি কর্পোরেশন।
”মুঘল আমলে মোমেনশাহ নামে একজন সাধক ছিলেন” এই সাধকের সমাধির অস্থিত্ব বা ইতিহাস এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। মুঘল আমলে ৩২টি মহাল নিয়ে ‘‘সরকার বাজুহা’’ গঠন করা হয়েছিল এবং ঈশা খাঁর ২২ পরগনার মধ্যে বড় পরগনা ছিল মোমেনসিং পরগনা। এই পরগনা কার নামে হয়েছিল এখন পর্যন্ত কোন ইতিহাস পাওয়া যায়নি। মোমেনসিং পরগনায় এই সাধকের সমাধির অস্থিত্ব বা কোন স্মৃতি চিহ্ন সরাসরি পাওয় যায়নি।
এই সব তথ্য ও বক্তব্যের সূত্র ধরে ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স এর যৌথ উদ্যোগে রেনেলের মানচিত্র সংগ্রহের মাধ্যমে মোমেনসিং পরগনাসহ প্রাচীন নিদর্শন খোঁজার জন্য ২০২০ সালে  প্রায় চার মাস ধরে জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। জরিপে সুলতান ও মুঘল আমলের নামবিহীন কয়েকটি সমাধি বা মাজার পাওয়া গিয়েছে।
উল্লেখযোগ্য যে, মোমেনসিং পরগনার  গৌরীপুর উপজেলার গুজিখাঁ গ্রামে ৫/৭ শত বছর আগের দু’টি প্রাচীন স্থাপনা ছিল। সুলতানী আমলের দু’তলা বিশিষ্ট্য মসজিদ যা দুই শত বছর ধরে এই ছোট মসজিদে কেউ নামাজ পড়তে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছে ১৭৮৭ এর ভুমিকম্পে নদীগুলোর দিক পরিবর্তনের সময়ে মসজিদের ২০ শতাংশ বা এর অধিক ভেঙ্গে যায়। পানি পড়তে পড়তে জঙ্গল বা ঝোপঝার পরিনত হয়। মসজিদের উপর তলা আধ্যাত্মিক ঘর এবং নিচ তলা মসজিদ। এ ছাড়া মসজিদ প্রাঙ্গণের পূর্ব পাশেই রয়েছে সুলতান আমলের তিন সিড়িঁ নির্মিত রওজা। মধ্যযুগীয় বাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য হিসেবে পাতলা ইটের সাথে চুন, সুরকির গাঁথুনি দ্বারা তিন সিড়িঁ নির্মিত রওজার একটি প্রকৃতি ও ধারা রয়েছে। স্থাপত্যশিল্প একটি দেশের কিংবা জাতির কোনো নির্দিষ্ট সময়ের মানব সংস্কৃতির অন্যতম দৃশ্যমান প্রতীক। মুসলিম শাসনামলে বাংলায় সর্বাধিক ধর্মীয় ইমারত নির্মিত হয়েছে। এটা কার রওজা কেউ বলতে পারতো না। অনেকে ধারণা করতেন, এখানে কোন পীর বা আউলিয়া শায়িত আছেন। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, মাজারের পাশে রয়েছে একটি মিনারের ধ্বংসাবশেষ পূর্বে ঝোপঝাড় ও মাটির স্তুপের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। এই সব উদাহরণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ১ মে ১৭৮৭ সালে  মোমেনসিং নাম দিয়ে জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ১৭৯১ ইং সালে নাসির উদ্দিনের নাম দিয়ে নাসিরাবাদ ময়মনসিংহের প্রধান জেলা শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৮৬৯ ইং সালে নাসিরাবাদ পৌরসভা এবং ১৮৯৯ ইং সালে নাসিরাবাদ রেল স্টেশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯০৫ ইং সালে নাসিরাবাদ রেল স্টেশনের নাম পরিবর্তনের সময়ে গোটা শহরের নাম পরিবর্তন হয়ে যায়।
ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় দেখা যায় যে, সুলতান আমলে নাসিরুজিয়াল পরগনায় নাসিরাবাদ নামে একটি রাজ্য ও সমগ্র এলাকা নিয়ে একটি প্রদেশ  আবার ইংরেজ আমলে আলাপসিং পরগনায় নাসিরাবাদ শহর; এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে একই নামে  দুই স্থানে নাসিরাবাদের অবস্থান-পূর্ব ময়মনসিংহ এবং পশ্চিম ময়মনসিংহ। আবার দু’টি স্থানের নামকরণে একই ব্যক্তি কিনা এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার ঃ 
 ১) ময়মনসিংহের বিবরণ-শ্রী কেদারনাথ মজুমদার ২) ময়মনসিংহের ইতিহাস-শ্রী কেদারনাথ মজুমদার ৩) ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার-শ্রী শৌরীন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ৪) ময়মনসিংহের সাহিত্য ও সংস্কৃতি-ময়মনসিংহ জেলা পরিষদ ৫) ময়মনসিংহের জমিদারি ও ভ’মিস্বত্ব- মো. হাফিজুর রহমান ভ’ঞা ৬) বাংলাদেশের প্রতœসম্পদ-আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া ৭) বাংলার ইতিহাস (সুলতানী আমল)-আব্দুল করিম ৮) ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন-দরজি আবদুল ওয়াহাব ৯) ময়মনসিংহের রাজপরিবার-আবদুর রশিদ ১০)  নেত্রকোণা জেলার ইতিহাস-আলী আহম্মদ খান আইয়োব ১১) জেমস রেনেল অংকিত প্রাচীন কয়েকটি মানচিত্র ১২)  বিভিন্ন জেলার উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া ও গুগল এর মাধ্যমে বিভিন্ন জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কিংবদন্তী সমন্ধে অবগত ও গবেষণা

13) A Description Of The Roads In Bengal And Bahar এবং  A General Map of the Roads in Bengal 14) The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760- Richard M. Eaton 15) The History of British India- James Mill 16) The history of two forts in Gouripur, Mymensingh ( An article published in the New Nation) 17) David Rumsey Historical Map Collection  18) New York Historical Society   ১৯) ’পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স ’ ম্যাগাজিন-২০১৮, ২০১৯, ২০২০- ইলেক্টোরাল কমিটি ও ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন, গৌরীপুর। ২০) ইতিহাস অনুসন্ধানী সংগঠন ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স। ২১) অমলেন্দু দে রচিত সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে।

এই পোস্টটি আপনার সামাজিক মিডিয়াতে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর
© All rights reserved © 2021 khobornetrokona
Developed by: A TO Z IT HOST
Tuhin