এই উপমহাদেশে তখন ব্রিটিশ শাসন। এখনকার ছাত্র ও শিক্ষক সমাজের অনেকেই বিশ্বেশ্বরী দেবী সম্পর্কে সেভাবে জানেন না। উনিশ শতকের এই বিধবা নারী গৌরীপুর এস্টেটে জমিদারির কাজে ও সেবায় নিজেই নিজেকে বিকশিত করেছিলেন।
নিঃসন্তান ও কিশোরী বয়সেই বিশ্বেশ্বরী দেবীর স্বামী রাজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী মাত্র ২৪ বছর বয়সে অকাল মৃত্যু হয়েছিল। স্বামীর বাল্যকালে শ্বশুর আনন্দ কিশোর রায় চৌধুরী মৃত্যু এবং বছর না ঘুরতেই পুত্রশোকে শাশুড়ি আনন্দময়ী দেবীর মৃত্যু হয়েছিল। ফলে জমিদারির হাল ধরার মতো কেউ ছিল না। ফলে বিশ্বেশ্বরী দেবীর অবস্থা হয়েছিল খুব শোচনীয়। তাঁকে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে হয়েছিল।
এই বিষয়টিতেই স্পষ্ট যে গৌরীপুরের জমিদারির উত্তরাধিকারী কে হবেন, এ নিয়ে মানসিক ভাবেও ভেঙ্গে পড়েছিলেন বিশ্বেশ্বরী দেবী। স্বামীর অকাল মৃত্যুতে বিশ্বেশ্বরী খুব দুঃখ পেলেন ঠিকই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন যখন জানতে পারেন, তার কাকা গোবিন্দ চক্রবর্তী বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই স্বার্থের জন্য রাজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীকে বিপথে পরিচালনা করেছিলেন।
গোবিন্দ চক্রবর্তীর এই ব্যাপারটি বিশ্বেশ্বরী দেবীর জ্ঞাতিগোষ্ঠীরা যে মেনে নিতে পারেননি, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হলো না। কিন্তু বিশ্বেশ্বরী দেবী যখন জমিদারি শুরু করেছিলেন তখনকার সমাজের কথা চিন্তা করলে দেখা যায়, তখন পুরুষকে পেছনে ফেলে ক্ষমতা নেওয়া এতোটা সহজ ছিল না। অথচ পাড়াগাঁয়ের একজন নারী সব অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। তিনি নারীর ক্ষমতায়নকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে কাজ করেছিলেন মানবকল্যাণে। নিজের ব্যক্তিত্ব তুলে ধরেছিলেন ব্রিটিশ রাজদরবারে। জীবন সংগ্রামে লড়ে একজন বড় জমিদারের স্ত্রী হিসেবে অনেক ত্যাগের মধ্যদিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। নিজের জমিদারি দেখাশোনা ছাড়াও মনোনিবেশ করেছিলেন জনহিতকর কাজে।
এখানেই বিস্মিত হবেন; যখন দেখবেন বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে বিশ্বেশ্বরীর তীর্থে যাওয়ার সময়ে তার স্বপ্ন অনুযায়ী স্বামীর গভীর ভালোবাসা ও স্মৃতি হিসেবে তার উপার্জিত অর্থ দিয়ে দত্তক ছেলের মাধ্যমে গৌরীপুরে একটি সুন্দর কারুকার্যখচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়েছেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাজেন্দ্র কিশোরের মৃত্যুর এক বছরের মধ্যেই দত্তকপুত্র ব্রজেন্দ্র কিশোরের জন্ম হয়। বিশ্বেশ্বরী নিজের ত্যাগ ও শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন মানুষের জন্য, নারীর জন্য। এই প্রজন্মকে জানতে হবে বিশ্বেশ্বরী দেবীকে। তাঁর আত্মজীবনী তাদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনা করা ছাত্র-ছাত্রীদের জানার সুযোগ করে দিতে হবে। তাহলে এখনকার ছেলেমেয়েরা আগামীকে জয় করার স্বপ্ন দেখবে এবংস্বপ্নকে জয় করবে।
বিশ্বেশ্বরী দেবীর ইতিবৃত্ত গবেষণা ও বিভিন্ন অনুসন্ধানী কাজ সম্পন্ন করেছে ময়মনসিংহের গৌরীপুরস্থ এসিক এসোসিয়েশন, ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স। তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শেকড় সন্ধানী তথ্য ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হলো।
রাজেন্দ্র কিশোর এই ‘নিঃস্বার্থ উপকারের’ জন্য গোবিন্দের প্রতি পক্ষপাত ও বশীভূত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি নাবালক, সম্পূর্ণরূপে কলকাতার ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনে অধীন, সুতরাং গোবিন্দ চন্দ্রকে এই প্রভুভক্তির পুরস্কার দেওয়ার ক্ষমতা তখন তার ছিল না। পড়াশুনা শেষ করে গৌরীপুরের জমিদারি গ্রহণ করার পর গোবিন্দ চন্দ্রের কাজের প্রতিদান যে অপূর্ণ থাকবে না তা তিনি তাকে জানিয়ে আশ্বস্ত করেছিলেন।
তখন গোবিন্দ চন্দ্রের অনেক দিনের আশা পূর্ণ করার জন্য সুযোগ বুঝে ধীরে ধীরে বললেন, “আমার কৃতকার্যের জন্য পুরস্কার দিবেন? এবং আমার প্রার্থনা পূর্ণ করবেন এই দুই প্রতিজ্ঞা আপনি গঙ্গার (পদ্মা নদী) উপরে করতেছেন, তখন কিছুতেই তা অন্যথা হবে না, তা নিশ্চিত। আমার ধন-সম্পত্তি বা অন্য কোনো কিছু চাই না, আমার একটি অবিবাহিতা ভ্রাতুষ্পুত্রী আছে, আপনি তাকে বিবাহ করে সুখী হবেন এবং আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করুন।”
এই এই কথা শুনে রাজেন্দ্র কিশোর স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। তখন সাহস করে তিনি কোনও উত্তর দিতে পারলেন না। গোবিন্দ চন্দ্র নিজের স্বার্থসিদ্ধি জন্য রাজেন্দ্র কিশোরের মূখের ভাব ও প্রকৃতি বিশেষ রূপে অধ্যয়ন করেছিলেন। তার ইতস্থত ভাব দেখে বিনীতভাবে বললেন, “আমার এই প্রার্থনা যে অনুচিত তা আমি জানি, কিন্তু আমার ভ্রাতৃকন্যা আপনার অযোগ্যা নহে। সুশীলা/চরিত্রবান, সুশিক্ষিতা পত্নী লাভ করে সুখী হতে পারেন, কেবল সেই জন্যই আমার এই প্রার্থনা।”
রাজেন্দ্র কিশোর উদার ও উচ্চমনা ছিলেন। কত ভাবনা যে তখন তাঁর মাথার মধ্যে ঘোরপাক খাচ্ছে! গোবিন্দ চন্দ্র চক্রবর্তী ইচ্ছা করলে এই সুযোগে অর্থ বা সম্পত্তি প্রার্থনা করে ধনবান হতে পারতেন; কিন্তু তিনি নিজের স্বার্থের দিকে না চেয়ে কেবল তার ভ্রাতুষ্পুত্রীকে বিয়ে কবার জন্য অনুরোধ করেছেন, তাতে তার স্বার্থের লেশমাত্র নেই, এই ভেবে তিনি গোবিন্দ্র চন্দ্রের প্রস্তাব রক্ষা করতে সম্মত হলেন।
বিশ্বেশ্বরী দেবীর সঙ্গে রাজেন্দ্র কিশোরের বিয়ে ও জমিদারির কৃতিত্ব :
যথাসময়ে মহাসমারোহে গোবিন্দ চন্দ্র চক্রবর্তীর বড় ভাই কেশব চন্দ্র চক্রবর্তীর মেয়ে বিশ্বেশ্বরী দেবীর সঙ্গে রাজেন্দ্র কিশোরের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর রাজেন্দ্র কিশোর জমিদারির দায়িত্ব নেন। ব্রিটিশ সরকারের প্রবর্তিত নিয়মানুসারে জমিদারি কার্য সম্পাদনের ব্যবস্থা করেন। প্রাচীন বিধি নিয়ম পরিবর্তিত হয়ে অতীব নিপুণতার সহিত জমিদারি কার্যের পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনা শুরু করেন। তিনি গৌরীপুর বাজারের সর্বাধিক উন্নতি সাধন করেলেন। তার সময়ে মুখুরিয়া গ্রামে প্রজাবিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। উত্তেজিত প্রজারা একযোগে খাজনা দিতে অস্বীকার ও জমিদারের প্রভুত্ব অমান্য করেছিলেন। তাদের দেখাদেখি অন্যান্য গ্রামেও বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়েছিল।
ইতিহাসে উল্লেখ আছে, রাজেন্দ্র কিশোর অতি দাপটের সঙ্গে এই বিদ্রোহ দমন ও প্রজাদের শাসন করে নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তার সময়ে সিলেট জেলার রাউর জমিদারি ও জামালপুর জেলার জাফরশাহীতে ইন্দ্রনারায়ণের তালুকের সামান্য অংশ কেনা হয়েছিল। প্রতাপে, প্রতিভায়, সুশাসনে, সুবিচারে, অল্পদিনের মধ্যেই রাজেন্দ্র কিশোর বিশেষ লোকপ্রিয় ও প্রজারঞ্জক জমিদার বলে সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন।
গোবিন্দ চন্দ্র চক্রবর্তীর ফাঁদে পড়ে রাজেন্দ্র কিশোরের কুপথে গমন:
বিশ্বেশ্বরী দেবী জানতেন না যে, তার কাকা একজন অসাধু, পরিবার ধ্বংসকারী, কুচক্রকারী, লোভী ও খারাপ প্রকৃতির লোক। গোবিন্দ চন্দ্র একরকম আশার স্বপ্ন দেখে এতদিন রাজেন্দ্র কিশোরের অনুগত ও উপকারী ছিলেন; কিন্তু এতদিন পর নিজের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল একটি সুন্দর রাজকীয় পরিবারকে ধ্বংস করা। তিনি বিস্তৃত জমিদারির সর্বময় কর্তা হলেন, অপর্যাপ্ত ধন সম্পত্তিশালী জমিদারের ঘনিষ্ট হলেন, কিন্তু তাতেও গোবিন্দ চন্দ্রের মন ভরেনি; বরং ছুটছেন ধন সম্পদের পেছনে।
রাজেন্দ্র কিশোর ছিলেন শিক্ষিত, পরিশ্রমী, প্রতিভাসম্পন্ন জমিদার। তাঁর চোখ ফাঁকি দিয়ে স্বার্থ সাধন করা খুব কঠিন কাজ। এ জন্য তার কূটনীতির জাল প্রসারিত করেন গোবিন্দ। রাজেন্দ্র কিশোরকে জুয়া, দিবানিদ্রা, পরনিন্দা, মদ্য, নৃত্য ইত্যাদির আসক্তি ও বিপথগামী করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করেন। অল্পদিনের মধ্যেই রাজেন্দ্র বিলাস তরঙ্গে আত্মহারা হয়ে ভুল পথে চলতে শুরু করলেন। এতদিনে গোবিন্দ চন্দ্র চক্রবর্তীর স্বার্থসিদ্ধির পথ সুগম হলো! তিনি জমিদারির অস্থায়ী ক্ষমতার অধিকারী হলেন। নিজের বিশ্বাসী অনুগত ব্যক্তিদের জমিদারির বিভিন্ন বিভাগে নিযুক্ত করেন। গোবিন্দ চন্দ্রের ভাই, ভাতিজা ও আত্মীয় স্বজনদের জমিদারির বিভিন্ন বিভাগের পরিচালনার দায়িত্ব দেন।
রাজেন্দ্র কিশোরের মাদকাসক্তি ও অসুস্থতার সুযোগে গোবিন্দ চন্দ্রের স্বার্থসিদ্ধি:
রাজেন্দ্র কিশোর আস্তে আস্তে জমিদারির দায়িত্ব ত্যাগ করতে শুরু করেন। অতি প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে নাম স্বাক্ষর করতে হলেও উদাসীনভাবে অর্থাৎ তিনি না দেখে না বুঝে স্বাক্ষর করতেন। এই সুযোগটি কাজে লাগায় গোবিন্দ চন্দ্র। তিনি বিভিন্ন অজুহাত তুলে মাঝেমধ্যেই সাদা কাগজে সাক্ষর করিয়ে রাখতে লাগলেন। ওই সমস্ত সাদা কাগজ ধীরে ধীরে তালুকের দানপত্রের রূপ ধারণ করলো। নিজের মতো করে গোবিন্দ চন্দ্রের স্ত্রীর নামে অনেকগুলো বড় বড় তালুকের দানপত্র বা দলিল এভাবে করা হয়েছিল। গোবিন্দর স্বপ্ন সফলতার মুখ দেখতে শুরু করলো। শেষে গোবিন্দ চন্দ্ৰ দেওয়ানের পদ লাভ করে জমিদারির সমস্ত কাজকর্ম দেখভাল করতে লাগলেন।
স্বামীর অকাল মৃত্যুতে তার শোক ও অনুতাপের সীমা রইলো না। শত প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও তিনি যদি সাহস করে স্বামীর বিলাস-ব্যসনে প্রতিরোধ স্থাপন করতেন তবে এই সর্বনাশ হতো না। রাজপ্রাসাদের চারদিকে এক উদ্ভূত স্থব্ধতা। তখন তার মন জ্বলছিল, চিন্তানলে দগ্ধ হতে লাগলেন তিনি। বাকী জীবনে সংসারে আর কোনো কামনাই রইলো না।
খলনায়ক গোবিন্দ চন্দ্র চক্রবর্তীর সকল আশার শেষ প্রান্তে দুঃখজনক পরিণতি:
লোভ মানুষকে পাপ কাজে নিয়োজিত করে এবং কুপথে ধাবিত করে। কথায় আছে, লোভে পাপ; পাপে বিনাশ। অসৎ কাজের কোনো কিছুই গোপন থাকে না। এক সময় গোবিন্দ চন্দ্র চক্রবর্তীর পরিবারে নিজেদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলো। তিনি গোপনে নিজের স্ত্রীর নামে যে তালুকগুলোর দলিল করে নিয়েছিলেন, ওই তালুকের অধিকার নিয়ে জ্ঞাতিদের সঙ্গে বিবাদ শুরু হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে এই বিষয়টি বেশিদিন গোপন থাকেনি। ক্রমেই এই কথা বিশ্বেশ্বরী দেবীর কানে আসতে থাকলো। গোবিন্দ চন্দ্র চক্রবর্তীর স্ত্রীর নামে যে কয়টি বড় বড় গ্রাম তালুক দেওয়া হয়েছিল তা বিশ্বেশ্বরী দেবী জানতেন না। এই নতুন খবর তিনি গোপনে অনুসন্ধান করে প্রকৃত অবস্থা খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিষয়টি জেনে বিশ্বেশ্বরী দেবী খুবই রাগান্বিত হয়েছিলেন। পিতৃতুল্য গোবিন্দ চন্দ্রের ওপর তার ঘৃণা জন্মায়।
রামগোপালপুরের জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্র কিশোর রায় চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, “গোবিন্দ চন্দ্রের পত্নীর নামে যে সমস্ত তালুক প্রদত্ত হইয়াছিল তজ্জন্য রাজদ্বারে অভিযোগ উপস্থিত করিলেন। বিশ্বেশ্বরী দেবীর অনুকূলেই বিচারের নিষ্পত্তি হইল ও তালুকের সনন্দ অসিদ্ধ এবং অলীক বলিয়া প্রতিপন্ন হইল। গোবিন্দ চন্দ্র বহু চেষ্টায় বহুদিনের সাধনায় কূটবুদ্ধির জাল বিস্তার করিয়া যে ফল লাভ করিয়াছিলেন তাহা তাহাদের উপভোগে আসিল না। কেবল নিন্দা ও কলঙ্কই সার হইল।”
বিশ্বেশ্বরী দেবী তার স্বামীকে অন্তর থেকে ভালোবাসতেন এবং দেবতুল্য মনে করতেন। কিন্তু তাঁর কাকা গোবিন্দ চন্দের কারণে তাদের স্বাভাবিক জীবন অস্বাভাবিক হয়েছিল। স্ত্রীর প্রতি সবসময় অবজ্ঞা ছিল রাজেন্দ্র কিশোরের। তার স্বামী জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন পরপারে। শেষ সময়টুকু স্বামীর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে ছিলেন তিনি।
জমিদারির দায়িত্ব এবং ব্রজেন্দ্র কিশোরকে দত্তক গ্রহণ:
স্বামীর স্মৃতি, স্বপ্ন আর সাহস বুকে ধারণ করে এবং মানসিক ধাক্কায় দ্রুত বদলে গিয়েছিল বিশ্বেশ্বরী দেবীর জীবন। একাকিত্ব ভাবনা থেকে সরে আসার জন্য নিজেকে জমিদারির কাজে মানিয়ে নিতে পারলে সামনের পথচলা হবে সাফল্যময়, তাই বিশ্বেশ্বরী দেবী স্বহস্তে জমিদারি তত্ত্বাবধানের ভার গ্রহণ করে বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে কর্তব্যের পথে অগ্রসর হতে লাগলেন। সর্বধর্মীয়, কল্যাণকর ও সমাজসেবার কাজে তার সাহায্য ও সহানুভূতি ছিল। স্বামী জীবিতকালে তিনি ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালে ১৫ হাজার টাকা দান করেছিলেন। ময়মনসিংহ জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার জন্য এককালীন আরো কিছু টাকা ও রাজেন্দ্র কিশোরের নামে একটি মাসিক বৃত্তি চালু করে দানশীলতা ও উচ্চহৃদয়ের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। কিশোরগঞ্জ জাতীয় বিদ্যালয়েও মাসিক সাহায্য প্রদান করেছিলেন তিনি। দীন দুঃখীর অভাব মোচনের জন্য প্রতিবছর বহু দান করা হতো। তার প্রবর্তিত নিয়ম অনুসারে প্রতি বৎসর অশোক অষ্টমী আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হতো। এ উপলক্ষে মোমেনসিং পরগনাসহ অন্যান্য পরগনার বহু সংখ্যক যাত্রীর গৌরীপুর শহরে তিন দিনব্যাপি ভোজের ব্যবস্থা থাকতো।
পরবর্তীতে বিশ্বেশ্বরী দেবীর পতির জলপিন্ড সংস্থানের জন্য অর্থাৎ উত্তরাধিকার হিসেবে পুরুষ দ্ধারা জমিদারী পরিচালনার জন্য ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে (বাংলা ১২৮৪ সালে) রাজশাহীর বালিহার গ্রাম নিবাসী হরিপ্রসাদ ভট্টাচার্যের পুত্র ব্রজেন্দ্র কিশোরকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। ব্রজেন্দ্র কিশোরের পূর্ব নাম ছিল রজনী প্রাসাদ ভট্টাচার্য। তিনি অতি অল্প বয়সে দত্তক গৃহীত হয়েছিল। ১২৮১ বঙ্গাব্দের ২৯ বৈশাখে (ইংরেজি ১২ মে, ১৮৭৪ সালে) রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলার বালিহার গ্রামে ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর জন্ম। বিশ্বেশ্বরী দেবী দত্তক পুত্র নেওয়ার জন্য অনেক জমিদার বাড়িতে খোঁজাখুঁজি করার পর জমিদার রাজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে ব্রজেন্দ্র কিশোরের জন্ম হয়।
ইতিহাস বলছে, এক সময় বিশ্বেশ্বরী দেবীর স্বামী রাজেন্দ্র কিশোরের অসুস্থ শরীর ও উদাসীনতার সময়েও তিনি জমিদারির দ্বায়িত্ব পালন করে পূর্ব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন।
দত্তক পুত্র গ্রহণের চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকারের সময়ে ব্রজেন্দ্র কিশোর জমিদারির দায়িত্ব নেওয়ার মতো বয়স হলে সম্পত্তির বিভাগ বিভাজন নিয়ে বিশ্বেশ্বরী দেবীর সঙ্গে মনোমালিন্য ঘটে। এই মত, বৈষম্য ও মনোমালিন্য হতে বিস্বাদের দাবানলে ঘি ঢালার জন্য অনেকেই উদ্যোগী ও ইচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যে পারিবারিক বিবাদ নিরসন হয়। মা-পুত্রের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ হয়ে গেল। ফলে সমস্ত সম্পত্তি এক চতুর্থাংশ বিশ্বেশ্বরী দেবীর হাতে রইল ও অপর তিন চতুর্থাংশ ব্রজেন্দ্র কিশোর সম্পত্তির অধিকারী হলেন। বিশ্বেশ্বরী দেবী পুত্রহীনা।
দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণের দশ বছর পর ব্রজেন্দ্র কিশোর ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে জমিদারির কার্যভার গ্রহণ করে অতি দক্ষতার সহিত কর্তব্য পালন করতে লাগলেন। তাঁর অসাধারণ প্রতিভাবলে অল্পদিনের মধ্যেই লোকসমাজে সুনাম অর্জন করেন। যশ, মান, সম্মানের সহিত তাঁর সম্পত্তিরও উন্নতি হতে লাগলো। সিলেট জেলা অন্তর্গত ছাতক জমিদারি ও অবনীকান্ত চৌধুরির জামালপুর জেলার অন্তর্গত জাফরশাহী পরগনার অংশ জমিদারি কিনে পৈত্রিক সম্পত্তির পরিধি বাড়িয়েছিলেন। হাট-বাজার প্রভৃতির সুবিধা করে দিয়ে, পানি চলাচলের জন্য খাল কাটা, পতিত জমিতে প্রজা বসতি স্থাপন করে সম্পত্তির উন্নতি সাধন করেছিলেন।
বিশ্বেশ্বরী দেবী শ্রেষ্ঠ ত্যাগী নারীর প্রতিরূপ ও তার তীর্থবাস:
ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদাদের ইতিহাস বইয়ের লেখক জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী গৌরীপুরের জমিদারদের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। তার লেখা ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ প্রথম খণ্ড থেকে জানা যায়, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের সীমিত অধিকার রয়েছে। এই সীমিত অধিকার নিয়ে একজন নিঃসন্তান যৌবন বয়সে বিধবা ও ত্যাগী নারী হিসেবে বিশ্বেশ্বরী দেবী আজীবন সততার সঙ্গে সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি ছিলেন শিক্ষিতা, মেধাবী, শিক্ষানুরাগী, ধার্মিক ও সমাজসেবক। তিনি ছিলেন স্বামীর আদর্শের একজন সৈনিক ও পূজারী। তিনি মনে প্রাণে স্বামীর প্রতি গভীর ভালোবাসা ধারণ করতেন। তিনি ছিলেন শিক্ষা, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক চর্চা, মানবিকতা, স্বদেশপ্রেম সকল গুণে গুণান্বিত একজন নারী। তিনি তাঁর কর্মের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। শিক্ষার উন্নতিকল্পে সর্বদাই তিনি ব্যস্ত থাকতেন। তিনি অতি পুণ্যশীলা রমণী ছিলেন। তাই তিনি তীর্থস্থানে যাওয়ার আগে তাঁর সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ তাঁর ছেলে ব্রজেন্দ্র কিশোরের কাছে হস্তান্তর করেন এবং উক্ত সম্পদের অর্জিত ও সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তাঁর স্বামীর নামে দেশের সবচেয়ে সুন্দর একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার জন্য বলে যান। ছাত্রদের মধ্যে চিরদিন বেঁচে থাকবেন প্রাণপ্রিয় এ মানুষটি।
রামগোপালপুরের জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্র কিশোর রায় চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থে বিশ্বেশ্বরীর তীর্থবাসের কথা উল্লেখ রয়েছে। তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো:
“বিশ্বেশ্বরী দেবী এখনও জীবিতা আছেন। ধর্ম চিন্তাই এক্ষণে তাহার একমাত্র অবলম্বনীয় হইয়াছে। জীবনে গৃহাশ্রমের কোন সুখই তাহার ভাগ্যে ঘটে নাই, গৃহ-বাসে তাহার আসক্তিও নাই। তীর্থস্থান ও গঙ্গাতীরই তাহার প্রকৃত বাসস্থান হইয়াছে। বর্তমান সময়ে তিনি বৈদ্যনাথ দেওঘরে অবস্থান করিতেছেন।”
বৈদ্যনাথ মন্দিরটি ভারতের দেওঘর শহরে অবস্থিত। দেওঘর হলো ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের পঞ্চম বৃহত্তম শহর। এটি সাঁওতাল পরগনা বিভাগের দেওঘর জেলার সদর শহর। এটি হিন্দু ধর্মের একটি পবিত্র স্থান। এখানে হিন্দু ধর্মের ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গসমূহের একটি অবস্থিত। শহরের পবিত্র মন্দিরসমূহ তীর্থযাত্রী ও পর্যটকদের কাছে শহরটিকে একটি গন্তব্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা শহরে ঈশ্বরগঞ্জ বিশ্বেশ্বরী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকালীন বিদ্যালয়টি মোমেনসিং ও জাফরশাহী পরগানার জায়গীরদার, গৌরীপুরের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী বংশের পঞ্চম পুরুষ ও গৌরীপুর রাজবাড়ির তৃতীয় জমিদার আনন্দ কিশোর রায় চৌধুরী (ঈশ্বর চন্দ্র চৌধুরী) এর পুত্রবধু, চতুর্থ জমিদার রাজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর সহধর্মিণী ও পঞ্চম জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর মা বিশ্বেশ্বরী দেবীর নামানুসারে বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় ‘বিশ্বেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়’। তাছাড়া সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর উপজেলায় ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ১ জানুয়ারি ১৯২০ সালে বিশ্বেশ্বরী রায় চৌধুরীর নামানুসারে মধ্যনগর বিশ্বেশ্বরী মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকালে তিনি প্রতিষ্ঠানের স্থান ও খেলার মাঠসহ ৫.৬০ একর জমিসহ নগদ অর্থ প্রদান করেছিলেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে নাম ছিল মধ্যনগর বিশ্বেশ্বরী এম ই (মাইনর এডুকেশন) স্কুল। সে সময়ে তৃতীয় শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু ছিল। সাধারণ মানুষের পানীয় জলের সুবিধার জন্য জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী নেত্রকোনা শহরে খনন করে নামকরণ করা হয় তার মায়ের নামে ‘বিশ্বেশ্বরী ট্যাংক’, যা নিউটাউন বড় পুকুর নামে পরিচিত।
গবেষণায় ও ইতিহাসের পাতা ঘাটলে দেখা যায়, ব্রজেন্দ্র কিশোরের পরবর্তী দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্বেশ্বরী দেবীর মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠা করেছিল। মায়ের মৃত্যুতে ভীষণভাবে শোকাহত হয়েছিলেন ব্রজেন্দ্র কিশোর। কেননা, বিশ্বেশ্বরীর ভূমিকা ছিল ব্রজেন্দ্র কিশোরের একদিকে মা ও অন্যদিকে বাবা। মায়ের কীর্তি ও স্মৃতিকে অবিস্বরণীয় করে রাখার জন্য তিনটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
ইতিহাসের এই মহীয়সী নারীকে স্মরণ করে রাখার জন্য তিনটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে কমপক্ষে তাঁর শিরোনামে একটি আলোচনাসভার আয়োজন করা উচিত। শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন সময়ের সাহসী এই নারী। বর্তমান ইতিহাসে তাঁর অবদান সেভাবে কখনোই প্রকাশিত হয়নি। তাই তাঁকে নিয়ে গবেষণার পরিধি বাড়াতে হবে। তিনি আমাদের কাছে শ্রেষ্ঠ ত্যাগী নারীর প্রতিরূপ হয়ে আছেন।