পূর্ব বাংলায় নবাব আমলে ব্রাহ্মণ জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র চাঁদরায়ের জমিদারি, বিদ্রোহ দমন ও প্রেম কাহিনী
মোমেনসিং ও জাফরশাহী পরগানার জায়গীরদার, গৌরীপুরের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের প্রতিষ্ঠাতা এবং বগুড়ার আদমদিঘীর কড়ই রাজবাড়ির প্রসিদ্ধ জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র চাঁদরায় ও এক বিদ্রোহী মুসলিম জমিদারের স্ত্রী বেগম রানীর সঙ্গে এক রাজকীয় প্রেম কাহিনী নিয়ে নানা জনে নানা ধরণের মজার মজার গল্প, গান, ইতিহাস ও কেচ্ছা বা কিস্সা রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র চাঁদরায় সর্ববিষয়ে পিতার উপযুক্ত পুত্র ছিলেন। তিনি পিতার নিকট মুর্শিদাবাদে থেকেই বিদ্যা শিক্ষা গ্রহণ করেন।
প্রথমতঃ চাঁদ রায় চন্দ্র কিশোর তলাপাত্র নামে পরিচিত ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের পিতা, পিতামহ সকলেই নবাব সরকারে চাকরি করে বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণও পিতৃপথানুসরণ করে নবাব দরবারে পরিচিত ও প্রতিপন্ন হওয়ার উদ্দেশ্যে ফারসি ভাষা শিখে প্রথম যৌবনে তিনি নিজ বিষয়সম্পত্তির তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং পরে মুর্শিদাবাদে গমন করবেন বলে স্থির করলেন। পরবর্তীতে নবাব সরকারে তার জ্যেষ্ঠ ছেলে চাঁদ রায় প্রথমে জনাব রায় রায়ান আলম চাঁদ-এর সহকারী সচিব হিসেবে চাকরি নেন।
# রাজস্ব সচিব হিসেবে চাদঁরায়ের ক্ষমতাঃ
তৎকালীন নবাব আলীবর্দী খাঁ’র দরবারের খালসা বিভাগের প্রধান কর্মচারী চাঁদ রায় চৌধুরী। পরবর্তীতে নবাব রাজ দরবারে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ ছেলে চাঁদ রায় প্রথমে জনাব রায় রায়ান আলম চাঁদ এর সহকারী সচিব হিসেবে চাকরি নেন এবং পরবর্তীতে নবাবের প্রিয়পাত্র হিসেবে জনাব আলম চাঁদের মৃত্যুর পর ‘রায় রায়ান’ উপাধিসহ খালসা বিভাগের রাজস্ব বিষয়ক সচিবের পদে অভিষিক্ত হন। শ্রীকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠ সন্তান বলে তিনি বড়ই সুপুরুষ নির্ভীক ও অসাধারণ বলবান ছিলেন। নবাব যুগে অশ্বারোহণে, তীর, তরবারি পরিচালনা প্রভৃতি বীরত্বপূর্ণ কাজে ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
# চাঁদরায়ের উদ্যোগে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জাফরশাহী পরগণা লাভ।
সে সময়ে জামালপুর জেলার জাফরশাহী পরগণার অবস্থা ভালো ছিল না। রাজস্বও অতি কম ছিল। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীকে ওই পরগণার দায়িত্ব প্রদান করলে জাফরশাহীর বিশেষ উন্নতি হবে এবং মোমেনসিং পরগণার রাজস্ব অক্ষুণ্ণ থাকবে, জানালেন জমিদারপুত্র চাঁদ রায়। এই পরামর্শই যুক্তিযুক্ত বলে গ্রহণ করলেন নবাব আলীবর্দী খাঁ। চাঁদরায় পূর্ব হতেই সরকারের বিশেষ অনুগৃহীত। ইতোপূর্বে ঘোড়াঘাটে একটি বিদ্রোহ দমন করে নবাব আলিবর্দী খাঁর প্রিয়পাত্র হয়েছিলেন। চাঁদ রায়ের চেষ্টা ও উদ্যোগে জাফরশাহী পরগণা মোমেনসিং পরগণার সাথে অন্তর্ভুক্ত করেন। মোমেনসিং পরগণার জন্য যে রাজস্ব নির্ধারিত ছিল, পরবর্তীতে মোমেনসিং পরগণা ও জাফরশাহী পরগণা মিলে উভয় পরগণার জন্য ওই রাজস্বই নির্দিষ্ট হলো। এক পরগণার রাজস্ব দিয়ে তিনি দুইটি সুবৃহৎ পরগণা ভোগ করার অধিকার পেয়েছিলেন।
# নবাব আলিবর্দৗ খাঁ হিন্দু কর্মচারীগণের প্রতি বিশ্বাসঃ
নবাব আলীবর্দী খাঁ হিন্দুদের প্রতি খুবই অনুকূল্য ছিলেন। তিনি হিন্দুদেরকে বিশ্বাস করতেন। হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবান ছিলেন এবং হিন্দুদের নিয়মকানুন অনুসরণ করতেন। মুসলমান অপেক্ষা হিন্দু কর্মচারীদের অধিক বিশ্বাস করতেন তিনি। নবাব আলীবর্দী খাঁ প্রায় ৬৫ বছর বয়সে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই বৃদ্ধ বয়সে তিনি সর্বদা যুদ্ধ কাজে নিযুক্ত থাকতেন এবং তাকে স্থানে স্থানে ভ্রমণ করতে হতো। যে অল্প সময় রাজধানীতে থাকতেন, তাও যুদ্ধের উদ্যোগ আয়োজনেই সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন। রাজ্যের আভ্যন্তরীণ অবস্থা পর্যবেক্ষণের সময় ও সুবিধা সহজেই পাওয়া যেতো না।
জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্র কিশোর রায় চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থ থেকে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো – ‘রায় রায়ান চাঁদ রায়ই সর্বেসর্বা হইয়া রাজ্যের সর্ব বিষয়ে কর্তৃত্ব করিতেন। এরূপ প্রগাঢ় বিশ্বাস কাহার ভাগ্যে ঘটিয়াছে? এরূপ বিশ্বাসের সদ্ব্যবহার কতজন করিতে পারিয়াছে?’
# নবাবের হুকুমে চাঁদরায় কর্তৃক ঘোড়াঘাট চাকলায় এক বিদ্রোহী মুসলিম জমিদারের শিরঃচ্ছেদ এবং তার স্ত্রী বেগম রানীর সঙ্গে এক রাজকীয় প্রেম কাহিনীঃ
ব্রাহ্মণ যুবরাজ রায় রায়ান চাঁদরায় সম্বন্ধে অনেক গল্প ও কবিতা প্রচলন আছে। ঘোড়াঘাট চাকলায় কোনো দুর্দান্ত মুসলমান জমিদারের শাসনের জন্য এবং তাকে যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য নবাব আলিবর্দী খাঁ তার বিশ্বাসত্ব কর্মকর্তা চাঁদরায়কে প্রেরণ করেন। বুদ্ধিমান চাঁদরায় হত্যাকাণ্ডের যুদ্ধ বা লোকক্ষয়কর যুদ্ধের অনুষ্ঠান অপেক্ষা কৌশলে কার্যসিদ্ধি করতে সাচ্ছ্যন্দ বোধ করেন এবং নবাবের কতগুলো উন্নতমানের ঘোড়া নিয়ে ঘোড়া ব্যবসায়ীরূপে উক্ত জমিদারের রাজ্যে উপস্থিত হন। কিছুদিন সেখানে বাস করতে করতে গরীবদের বহু অর্থ সাহায্য সহায়তা করেন। অনেক গরীব লোকদের অভাব মোচন করেন এবং জমিদারের কর্মচারীদেরকে অর্থে ও সৌজন্যে বশীভূত করেন। এমন সওদাগরের অপরূপ রূপ, অপূর্ব দানশক্তি ও অর্থের প্রচুরতা দেখে স্থানীয় লোকজন তাকে কোন ছদ্মবেশি রাজপুত্র বলে মনে করতেন। তার পৃষ্ঠপোষক লোকের অভাব ছিল না। পর্যাক্রমে এই খবর জমিদারের কানে পৌঁছাল। রাজার পত্নী বেগম রানী তাকে দেখতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।
চাঁদরায় জমিদার বাড়ির অন্তঃপুরে হাজির হলে রানী তাকে দেখে স্তম্ভিত হলেন এবং তার রূপ-লাবণ্যে মোহিত হলেন। যেমন রহস্যময় এক রাজপুত্র, তেমনি রহস্যময় তার প্রেম। রানীও ছিলেন পরমাসুন্দরী হিসেবে সেসময়ের ট্রয় নগরের হেলেন বা ক্লিওপেট্রার মতো এক রহস্যময়ী নারী। তখন চাঁদরায় তার লক্ষ্য ও সুবিধা অন্বেষণ করতে লাগলেন। বেগম রানীর হাবভাব বুঝে তার প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করতে লাগলেন। তাদের প্রেম গভীর হওয়ার পর রূপে পাগল বেগম রানী ব্রাহ্মণ রাজপুত্র চাঁদরায়ের প্রতি এতই অনুগত হলেন যে, তার নিজ স্বামীর জীবন নাশের প্রস্তাবে সম্মতা হলেন। চাঁদরায় রানীর কৌশলে গুপ্তভাবে অন্দরমহলে প্রবেশ করেন এবং নিদ্রিত অবস্থায় জমিদারকে হত্যা করে রাজপ্রাসাদ থেকে বাহিরে যাবার সময় বেগম সাহেবা জিজ্ঞাসা করেন, “মেরা ওয়াস্তে কৌন হ্যায়”। চাঁদরায় উত্তর করেন, “তোমহারা ওয়াস্তে হাম হ্যায়।”
বেগম রানী ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা বলে চাঁদরায়কে নিরাপদে অন্দরমহল থেকে বাহির করতে সাহায্য করেন। পরদিন চাঁদরায় সৈন্যসামন্ত-সহ রাজবাড়ি বেষ্টন করেন, কিন্তু জমিদারের মৃত্যুতে পরিবারবর্গ শোকার্ত ও শঙ্কিত হয়েছিল বলে সহজেই চাঁদরায়ের বশ্যতা স্বীকার করেন। বেগম রানীর সঙ্গে যে প্রেম ঘটনা ঘটেছিল, তা রক্ষার জন্য তিনি তার রক্ষণাবেক্ষণের ভার গ্রহণ করেন। তারপর চাঁদরায় নিহত জমিদারের মুণ্ডটি নবাব দরবারে আনয়ন করেন। নবাব আলিবর্দী খাঁ চাঁদরায়ের কাজের প্রতি খুশি হয়ে উপযুক্ত পুরস্কার প্রদান করলেন। তখনকার থেকেই মুসলমান জমিদারের পত্নী বেগম রানী এবং ব্রাহ্মণ রাজপুত্র চাঁদরায়কে নিয়ে গল্প-কবিতা-উপন্যাসের পাশাপাশি নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন গান ও গীত।
# সামাজিক কারণে চাঁদরায় বেগম রানীকে বিয়ে ও রক্ষণাবেক্ষণ করা অস্বীকার এবং রাণী রাগণ্বিত হয়ে চাঁদরায়ের একমাত্র ছেলে সোনারায়কে কড়ই গ্রাম হতে বন্দি করে নিয়ে আসাঃ
আমরা সকলেই জানি কোনো এক সময় কোনো রাজা বা যুবরাজ অন্য কোনো রাজ্য দখল করলে সে রাজ্যের পরাজিত রাজার স্ত্রীকে বিয়ে করতেন। যেমন রাজা ইডিপাস। প্রবাদ আছে যে, ‘বিধির লিখন যায় না খন্ডন’।ভাগ্যে লেখা থাকলে দুর্ভোগ পোহাতে হবেই। নিয়তি যেভাবে মানুষকে নিয়ে খেলবে, মানুষ সেভাবেই খেলবে। মানুষ হলো পুতুল। যুবরাজ চাঁদরায়ের ছেলে সোনা তলাপাত্র (সোনা রায়) ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সন্তানের মা মৃত্যুবরণ করেন। এখানেই চাঁদরায়ের জীবনে ট্র্যাজেডি নিহিত। প্রসূতি সময়ে যুবরাজ চাঁদরায়ের পত্নীর অকাল মৃত্যু, বেগম রানীর প্রতি অনুরাগ, ধর্মের প্রতি সংবেদনশীল, বিভিন্ন সামাজিক চাপ ইত্যাদি কারণে তিনি তার নিজের মনকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। এমনকি তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে রাজি হননি। কিছুদিন সময় অতিবাহিত হলে চাঁদরায় উক্ত বেগমের বিয়ে ও রক্ষণাবেক্ষণের ভার বহন করতে অস্বীকার করেন। বেগম রানী চাঁদরায়ের ব্যবহারের খুব রাগান্বিত হলেন এবং চাঁদরায়ের প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার মনস্থ করলেন।
জীবনযন্ত্রণায় সূর্যের মতোই তেজ রানীর। চাঁদরায় মুর্শিদাবাদ নবাব প্রাসাদে অবস্থান করে রাজকার্য করেন অতএব সেখানে তাকে প্রতিশোধ নেওয়া দুরূহ ব্যাপার। এভাবে দিন পেরোতে পেরোতে সোনা রায় ১৬ বছরে পরিপূর্ণ হলো। বিবাহযোগ্য ছেলে হওয়ার আগেই বেগম রানী কোনো উপায় না দেখে চাঁদরায়ের পুত্র সোনা রায়কে ধরে আনার জন্য বগুড়ার কড়ই রাজ্যে গুপ্তভাবে কয়েকজন অস্ত্রধারী সৈন্য প্রেরণ করেন। অবশেষে রাজপ্রাসাদ থেকে সোনা রায় কোনো উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। এই সুযোগে সৈন্যরা সোনা রায়কে রাস্তা হতে ধরে বেগম রানীর কাছে আনেন। বেগম রানী সোনা রায়কে বন্দি করে কোনো এক নিরাপদ স্থানে অতি সাবধানতার সঙ্গে রক্ষা করেন এবং তার রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ে করাতে স্থির করেন। মুসলিম দিনপুঞ্জি ও চাঁদ উঠার তারিখ অনুসারে বিবাহের দিন ধার্য হলো। রাজপুত্র সোনা রায় নানারূপ আপত্তি দেখিয়ে ক্রমে কিছুদিন অতিবাহিত করলেন। কোনো একদিন এক প্রহরীকে নিজের স্বর্ণ অঙ্গুরীয় উৎকোচ স্বরূপ প্রদান করে অব্যাহতি লাভ করেন।
বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার নামকরণ করা হয় শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর অতি আদরের প্রথম পৌত্র (নাতি) সোনা তলাপাত্র বা সোনা রায় এর নামানুসারে। তা ছাড়াও জমিদার শৌরীন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর সময়ে রাজকন্যার সঙ্গে সোনা রায়ের বিবাহ সম্বন্ধে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে লোকগাথা প্রচলিত ছিল।এই অমর লোকগাথা প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তির পূর্বে বগুড়া ও রাজশাহী অঞ্চলে গীত হয়ে কাহিনীর প্রচলন ছিল। যেমন
# বৃদ্ধ পিতা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর আদেশ ও অনুরোধে চাঁদরায় মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে বগুড়ার কড়ই রাজপ্রাসাদে আগমনঃ
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী জমিদারি প্রাপ্তির পর হতে শাসন ও বন্দোবস্ত কাজে লিপ্ত ছিলেন। জমিদারি কাজের বেশি পরিশ্রমে তার স্বাস্থ্যভঙ্গ হয়। তিনি জীবনের শেষ ধাপ অর্থাৎ বার্ধক্য চলে আসে। বিভিন্ন পরগনার বিপদসঙ্কুল পথ পেরিয়ে তার পক্ষে জমিদারি কাজ করা সম্ভব নয়। কোনো কর্মচারী দ্বারা এই সব জমিদারি কার্য করা তখনও সম্ভব ছিল না। তাই তিনি জ্যেষ্ঠ পুত্র চাঁদরায়কে জমিদারির তত্ত্বাবধান করতে আহ্বান করলেন। চাঁদরায় পিতার আদেশে প্রথমে বগুড়ার কড়ই রাজবাড়িতে উপস্থিত হন।
# মোমেনসিং পরগনায় প্রজাবিদ্রোহ দমনের জন্য প্রথমে বোকাইনগর বাসাবাড়িতে আগমন এবং নেত্রকোণার নন্দীপুর গ্রামে চাঁদরায়ের নতুন বাসস্থান নির্মাণঃ
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র চাঁদরায় চৌধুরী নেত্রকোণার মদনপুর ও বেখৈরহাটির কাছে নন্দীপুর গ্রামে কাছারিবাড়ি নির্মাণ করেন। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার বোকাইনগরে অবস্থিত বাসাবাড়ি শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মোমেনসিং পরগানার প্রধান কাননগো অফিস ও কাছারি রাজবাড়ি ছিল। চাঁদরায় বৃদ্ধ পিতার আদেশ অনুসারে বগুড়ার আদমদিঘি উপজেলায় অবস্থিত শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর কড়ই রাজবাড়ি নামক বাসস্থান হতে গৌরীপুরের বোকাইনগর বাসাবাড়ির দিকে যাত্রা করেন। পরবর্তীতে মোমেনসিং পরগনার মধ্যস্থলে জমিদারি কার্য পরিচালনা এবং প্রজাবিদ্রোহ দমনের জন্য বর্তমান গৌরীপুর উপজেলার সীমানায় ঘেষা নেত্রকোণার মদনপুর সংলগ্ন নন্দীপুর গ্রামে বাসস্থান নির্মাণের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। মোমেনসিং পরগনার প্রজাবিদ্রোহ সে সময়ে একইভাবে ছিল। দত্ত ও নন্দীদের বশীভূত ও অনুগত প্রজারা সর্বতোভাবে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর শাসন বহির্ভূত ছিল। সিন্ধা পরগণার মুসলমান জমিদারও পূর্ব বিদ্বেষ তখনও ত্যাগ করেননি। সে সময়ে তিনি এ বিদ্রোহের দমনের জন্য বদ্ধপরিকর হলেন।
রামগোপালপুর জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায় চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘‘চাঁদরায় পিতার আদেশানুসারে বাসাবাড়ি অভিমুখে যাত্রা করিলেন। বাসাবাড়িতে থাকিয়া কার্য করা সুবিধাজনক মনে করিলেন না। বিশেষত অধিকৃত স্থানের মধ্যস্থলে বাস না করিলে সর্ব দিকে সমান দৃষ্টি রাখার ব্যাঘাত ঘটিবে। এই জন্য তিনি প্রসিদ্ধ মদনপুরের নিকট নন্দীপুর নামক স্থানে উপস্থিত হন। মদনপুরে তখন বহু সম্ভ্রান্ত মুসলমানের বাসস্থান ছিল। মদন নামক একজন কোচবংশীয় ব্যক্তির নামানুসারে এই স্থানের নাম মদনপুর হইয়াছে। চাঁদরায় মদনপুরের উন্নত অবস্থা দেখিয়া তাহার সন্নিকটে স্বীয় কাছারি বাড়ি স্থাপন করিলেন। তিনি নন্দীপুর গ্রামবাসী দুর্গারাম ও তুলারামদের বাটিতে বাস করিয়া স্বীয় কাছারি বাড়ি নির্মাণ করেন। অচিরেই নন্দীপুরের মাঠে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বাসগৃহ, সৈন্যাবাস প্রভৃতি নির্মিত হইল।’’
# চাঁদরায়ের বিদ্রোহ দমন, শান্তি ও বন্দোবস্তঃ
# নেত্রকোণার মদনপুর ও বেকৈরহাটির নিকট নন্দীপুর গ্রামে চাঁদরায়ের চব্বিশ বিঘা দিঘী এখনও ইতিহাসের সাক্ষীঃ
শত বছর আগে রামগোপালপুরের জমিদার শৌরীন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর লেখা প্রমাণ করে যে, নন্দীপুরে গড়ে উঠা প্রাচীন কাছারি বাড়িটি অতীত গৌরবের নিদর্শন। নন্দীপুরের বিবরণ সম্বন্ধে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো – ‘চাঁদরায় নন্দীপুরে অতি বিস্তৃত স্থান ব্যাপিয়া যে কাছারি বাটি নির্মাণ করিয়াছিলেন, তাহার ভগ্নাবশেষ এখনও পূর্ব প্রতাপের ও অতীত গৌরবের নিদর্শন-স্বরূপ বর্তমান আছে। একটি সুবৃহৎ দীর্ঘিকা আছে, তাহার আয়তন প্রায় চব্বিশ বিঘা। সে স্থানে যে ধনাগার ছিল তাহার কিয়দংশ এখনও অবিকৃত আছে। একটি শিবমন্দির তাহার ধর্মশীলতার পরিচয় দিতেছে। কাল-চক্রের নিষ্পেষণে চাঁদরায়ের কীর্তিকলাপ অতীতের ধূলি-কণায় মিশিয়াছে, কিন্তু লোক সমাজে তিনি যে দক্ষতা, প্রতিভা ও প্রতাপের পরিচয় দিয়া গিয়াছেন, যতদিন গুণের আদর থাকিবে, যতদিন নিঃস্বার্থ প্রভুপরায়ণতার প্রতিষ্ঠা থাকিবে, ততদিন তাহার গৌরব-মণ্ডিত-গুণ-গাথা ইতিহাস পৃষ্ঠায় সুবর্ণ অক্ষরে চির সমুজ্জ্বল থাকিবে।’
বর্তমান (২০২২) তৎকালীন নবাব আলীবর্দী খাঁ’র আমলে রণনায়ক চাঁদরায় কর্তৃক প্রায় ২৪ বিঘা (৭৯০ শতাংশ) আয়তনের সুবিশাল দিঘিটি রয়েছে। দিঘির পাড়সহ ৪০টি বাড়ির জন্য গুচ্ছগ্রামের সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করেন বাংলাদেশ সরকার। এখনও রণনায়ক চাঁদরায় কর্তৃক ২৪ বিঘা দিঘিটি অতীত গৌরবের নিদর্শন হিসেবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গুচ্ছগ্রামের নন্দীপুর আদর্শগ্রাম বহুমখী সমিতি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি মোঃ রইছ মিয়া বলেন, দিঘির পাড়সহ এখানে ৬ একর ৬৯ শতাংশ ভূমি রয়েছে তাদের সমিতির জন্য। পুকুরের পানি রয়েছে ৫০০ শতাংশের মধ্যে। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী তিনি শুধু জানেন, পুকুরটি ছিল গৌরীপুরের জমিদারবাড়ির অধীনে।
# নন্দীপুর গ্রামে চাঁদরায়ের দাসীবাড়ির ধ্বংশাবশেষ ও পুকুর এখনও স্মৃতির স্মারকঃ
নন্দীপুর গ্রামে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা ও নিদর্শন দেখা যায়। এর মধ্যে অন্যতম দাসীবাড়ির ধ্বংশাবশেষ। প্রায় ২৮০ বছর আগে নির্মাণ করা দাসীবাড়ির ধ্বংশাবশেষ এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর পাশেই রয়েছে ইতিহাস বিজড়িত একটি দিঘি। যার নাম ‘দাসীবাড়ির দিঘি বা পুকুর‘। প্রায় শতবছর ধরে অযত্নে আর অবহেলায় পড়ে থাকা ঐতিহাসিক এই দু’টি নিদর্শন হতে পারতো নন্দীপুরের সম্ভাবনাময় একটি পর্যটন কেন্দ্র। চাঁদরায়ের সময়ে এই দাসীবাড়িতেই আনন্দ-কোলাহলে মুখরিত থাকতো। চাঁদরায়ের অবসর সময়ে তাকে সেবা দেওয়ার জন্য সুন্দর সুন্দর দাসীদের সমারোহে নাচ, গান, আমোদ-প্রমোদ ও বিভিন্ন ভোজ হতো।
পরবর্তী জমিদার যুগল কিশোর রায় চৌধুরীর আমলে মোমেনসিং পরগানার নাম থেকেই বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা নামকরণ করা হয়। যেমন সেসময়ে কালেক্টর অব মোমেনসিং, ম্যাজিস্ট্রেট অব মোমেনসিং ইত্যাদি ইংরেজদের পদের নাম থেকে জেলা নামকরণের ইতিহাস সহজে বোঝা যায়। চাঁদ রায় চৌধুরীসহ অন্যান্য জমিদারদের বিস্তারিত ইতিহাস ‘পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিন-২০২৩’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হবে।