জমিদার বাড়ির স্মৃতিস্বরূপ এখন একটি দ্বিতল ভবন, রানীপুকুরসহ বেশ কয়েকটি পুকুর, প্রাচীন পাতলা বা চিকন ইটের মোটা প্রাচীর দেওয়াল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। এই দ্বিতল ভবনটিও এখন অনেকাংশ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমানে বসতভিটা ছাড়া তেমন আর সম্পত্তি নেই।
উল্লেখ্য, ১ম তরফের বসতভিটার উত্তর দিকে ২য় তরফের দালান ঘর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বেই বিক্রি বা ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমানে বাড়িটির উভয় তরফের জায়গায় স্থানীয় কয়েকটি মুসলিম পরিবার বসবাস করছেন। এই জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার কড়ই রাজবাড়ির জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী। তার নামেই এই বোকাইনগর জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা স্থানীয়দের কাছে পরিচিত।
বাসাবাড়ি নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ পরগনার কামরূপ সম্প্রদায়ের ইতিহাস। প্রাচীনকালে মোমেনসিং পরগনাসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন নদীর তীরবর্তী এলাকায় কামরূপ জনগোষ্ঠীর কোচ, মেচ, হাজং, গারো, ভূটিয়া ইত্যাদি সম্প্রদায়ের বসতি স্থাপন করে। প্রতি সম্প্রদায়ের একটি করে রাজা থাকতো। তাঁরা ছিল জঙ্গলবাসী ও কৃষক প্রকৃতির। তাই বন-জঙ্গল, গাছ-গাছালি, গ্রামের প্রকৃতি, ফুল, ফল, ফসল, শস্য ইত্যাদির নাম দিয়ে তারা এক একটি রাজ্য বা এলাকা তৈরি করতো। যেমন – জঙ্গলবাড়ি, সরিষাবাড়ি, বাইগনবাড়ি, বড়ইবাড়ি, বাশঁবাড়ি, কমলাবাড়ি, কাঠাঁলবাড়ি, ধানবাড়ি, সেগুনবাড়ি, ফুলবাড়ি, নালিতাবাড়ি ইত্যাদি। বাসাবাড়ির প্রাচীন নাম ছিল ‘বাশঁবাড়ি’। এ সম্পর্কে ধারণা করা যায় যে, পরবর্তী জমিদারগণ ‘বাশঁবাড়ি’ নামের পরিবর্তে বাসাবাড়ি নামকরণ করেন এবং ঠিক তেমনি রেনেলের অংকিত মানচিত্রে ‘মোমেনসিং’ পরগনার পরিবর্তে ‘পরগনা ময়মনসিংহ’ নামকরণ করেন।
ময়মনসিংহ (মোমেনসিং) পরগনা থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহের নামকরণঃ
ব্রিটিশ ভূবিদ জেমস রেনেলের মানচিত্র ও ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ইতিহাসের পাতা ঘাটলে দেখা যায়, মোমেনসিং নামটি প্রথমে পরগনা: পরে উপ-প্রদেশ বা বৃহত্তর জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের পর ইংরেজদের পেশা-পদবী এবং বিভিন্ন চিঠি পত্র-তারিখসহ অফিসিয়্যাল ডকুমেন্ট থেকে ময়মনসিংহের ইতিহাস আরও সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। যেমন,, Board of Revenue Proceedings, 11th-18th April, 1788 : A letter from the Collector of Momensing : In the mean time I do myself, the honour to enclose an account of the Bazar prices of rice during the Pous and Maug Months of the Bengal year 1192, 1193 and 1194 in which it is useless to further remarks—. I am & W Wroughton, Collector— Momensing The 9th April 1788. ### তৎকালীন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নাম, পেশা-পদবী ও তারিখ Magistrate of Momensing, Mr. J. Straccy: 29th January.1802.### The East-India Register and Directory for 1819 (Second Edition) গ্রন্থে পদবীসহ ইংরেজদের নাম ও সন উল্লেখ আছে। যেমন Charles Smith, judge and magistrate of Momensing (1803), David Scott (2nd), Collector of Momensing (1805), Edward John Harrington, register of the zillah of Momensing (1808), Henry Moore, additional register of the zillah court of Momensing (1810), David Turnbull, surgeon, Momensing (1816); সুতরাং, রেনেলের মানচিত্র অথবা ইতিহাস থেকে পিছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, মোমেনসিং পরগনার নামের সঙ্গে ইংরেজদের পেশা-পদবীর সাথে ’মোমেনসিং’ নামটি মিল থাকায় বোঝা যায় মোমেনসিং পরগনা থেকে ’ময়মনসিংহ’ নামের সৃষ্টি।
জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্র কিশোর রায়চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থ থেকে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো – “(১) ময়মনসিংহ পরগনার অনেক স্থান জলপূর্ণ ছিল। নিম্নভূমিতে শস্যাদি উৎপন্ন হইত না।….. (২) শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী ময়মনসিংহ ও জফরসাহী এই দুইটি সুবৃহৎ পরগণার অধিকারী হইয়া জনসমাজে বিশেষ খ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত হইলেন। সম্ভ্রান্ত জমিদার বলিয়া নবাব দরবারেও তাহার মর্যাদা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইল। উভয় পরগণার শাসন, শৃঙ্খলা ও বন্দোবস্ত কার্য শেষ হইলে তাহার অর্থাগমের পথ সুগম ও নিষ্কণ্টক হইল। ধনে, মানে, ঐশ্বর্যে তিনি উন্নতির উচ্চ সোপানে উঠিয়া যশজ্যোতিতে দেশ আলোকিত করিলেন।” ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুরের বোকাইনগরের বাসাবাড়ির ইতিবৃত্ত গবেষণা ও বিভিন্ন অনুসন্ধানী কাজ সম্পন্ন করেছে গৌরীপুরস্থ এসিক এসোসিয়েশন, ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স।
অনুসন্ধানী ও গবেষণার তথ্য অনুযায়ী ময়মনসিংহ জেলার নামকরণের ইতিহাস জানার আগে মোমেনসিং পরগনার নামকরণের ইতিহাস জানা প্রয়োজন। উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন অনলাইনের তথ্যানুসারে, মোগল আমলে মোমেনশাহ নামে একজন সাধক ছিলেন, তাঁর নামেই মধ্যযুগে অঞ্চলটির নাম হয় মোমেনশাহী। ইতিহাস বিশ্লেষণে এ নিয়েও রয়েছে অনেক মতান্তর। মোমেনসিং পরগনায় অনেকগুলো মাজার শরীফ রয়েছে। তবে মোমেন শাহ্ নামে কোন সাধক, ওলি বা পীরের মাজারের অনুসন্ধান করলে এখন পর্যন্ত কোন প্রামাণিক ইতিহাস পাওয়া যায়নি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সুলতানী আমলেই পরগনা সৃষ্টি হয়। ৩২ পরগনা নিয়ে সরকার বাজুহার ঐতিহাসিক বর্ণনায় সুলতান বা মুঘল আমলে মোমেনসিং ও আলাপসিং পরগনার নামকরনের সময়ে বিখ্যাত দুই ব্যক্তি- আলাপশাহ্ ও মোমেনশাহ্ এবং তাদের নামের সাথে কেন ’সিং’ যুক্ত করা হয়েছিল তা সঠিক ইতিহাস এখন পর্যন্ত (২০২৩) খুজেঁ পাওয়া যায়নি। তবে জনশ্রুতি আছে নামের সাথে ’সিং’ যুক্ত পদবী এখানে নেতৃত্বের খেতাব বা উপাধি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। তাছাড়াও ’সিং’ এখানে সিংহাসন ও রাজ্য হিসেবেও গণ্য হতো। এ খেতাব যাদেরকে দেওয়া হতো তাদেরকে কোন পরগনার রাজা বা প্রধান সর্দার অথবা পরগনার সেনাপতি হিসেবে বিবেচিত হতেন। যেমন সিংনছরত (একটি পরগনার নাম) যার অর্থ রাজা নছরত , সিংধা মৈন ( একটি পরগনার নাম) যার অর্থ ধামৈন এর রাজ্য। ,সিংজানী যার অর্থ রাজা জানী বা জন বাহাদুর। এখানে একটি প্রশ্ন থাকতে পারে যে, ব্রাহ্মণ জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর পূর্ব নাম ছিল শ্রীকৃষ্ণ তলাপাত্র এবং তার পৌত্র সোনারায় এর পূর্ব নাম ছিল সোনা তলাপাত্র। সোনা তলাপাত্র নাম দিয়ে একটি জায়গার নাম হয়েছে সোনাতলা; বর্তমানে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলা। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর সময়ে বগুড়ার কড়ই জমিদার শ্রীকৃষ্ণ তলাপাত্র নবাব দরবারে সামন্য কর্মচারী পদ হতে ‘চৌধুরী’ উপাধিসহ কাননগুর পদে উন্নীত হলেন। শ্রীকৃষ্ণ তলাপাত্র ‘চৌধুরী’ উপাধিতে ভূষিত হলে তার নামের সাথে ‘তলাপাত্র’ শব্দটি বাদ পড়ে যায়।
এই উদাহরণ দিয়ে ইতিহাস পর্যালোচনায় করে জানা যায় যে, মুঘল বা সুলতান আমলে মোমেন শাহ্ নামে কোন বীর যোদ্ধা বা সেনাপতি ‘সিং’ উপাধিতে ভূষিত হলে তার নামের সাথে ‘শাহ্’ শব্দটি বাদ পড়ে যায়। তখন তার নাম অনুসারে পরগনার নাম হয় ‘মোমেনসিং’ বা ‘সিংমোমেনশাহী’ অথবা ‘মোমেনশাহী’।
মোমেনশাহী পরগনার বিষয়ে জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্র কিশোর রায়চৌধুরীর কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো – “ঐ সময় শ্রীকৃষ্ণ সরকার বাজুহার অন্তর্গত ময়মনসিংহ পরগণা প্রাপ্ত হইলেন। ঐ বৃহৎ পরগণা পূর্বে মোমিনসাহী নামে অভিহিত হইত। জঙ্গলবাড়ির দেওয়ান বংশের প্রতিষ্ঠাতা দ্বাদশ ভৌমিকের অন্যতম ভৌমিক সুপ্রসিদ্ধ ঈশা খাঁ পূর্বে এই মোমিনসাহী পরগণার অধিকারী ছিলেন। কালক্রমে সপ্তদশ শতাব্দীতে এই জমিদারি মঙ্গলসিদ্ধ গ্রাম নিবাসী দত্ত বংশীয়দিগের অধিকারগত হয়। দত্ত বংশীয়েরাই কিছুদিন পরগণার অধিকারী ছিলেন। কালক্রমে রামপুরের নন্দী বংশীয় কোন ব্যক্তি দত্ত বংশে বিবাহ করিয়া বিবাহের যৌতুক স্বরূপ ঐ জমিদারির ছয় আনা অংশ প্রাপ্ত হন।”
ইতিহাসের পাতা ঘাটলে দেখা যায়, জমিদার কৃষ্ণগোপালের দত্তকপুত্র ও নবাব সিরাজের অপর স্ত্রী আলেয়া (হীরা বা মাধুবী) তাঁর গর্ভে জন্ম নেওয়া পুত্র সন্তান, গৌরীপুর রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময়ে ময়মনসিংহের সবচেয়ে প্রতাপশালী জমিদার যুগল কিশোর রায় চৌধুরীর আমলেই সমগ্র ‘সরকার বাজুহার’ পরিবর্তে মোমেনসিং পরগনার নাম দিয়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহের নামকরণ করা হয়। তখন জেলার নাম ছিল মোমেনসিং এবং নাসিরাবাদ বা বাইগনবাড়ি ছিল জেলা শহর। অন্যদিকে সরকার বাজুহার পূর্ব নাম ছিল নাসিরাবাদ নামে একটি প্রদেশ। কামরূপ রাজ্যগুলো জয় করার শুরুর দিকে এই প্রদেশের রাজধানী ছিল ভারতের আসামে। পরবর্তীতে পূর্ব ময়মনসিংহের নাসিরাজুয়াল (কেন্দুয়া ও তাড়াইল) পরগনায়। মুঘল আমলে এই প্রদেশের নাম পরিবর্তন হয়ে ৩২টি পরগনা মিলে গঠিত হয় ‘সরকার বাজুহার’।
শ্রী কেদারনাথ মজুমদারের মতে, আসামের পাহাড়ি অঞ্চলের কামরূপ হতে নছরৎ পলায়ন করে মুয়াজ্জমাবাদ (বর্তমান পূর্ব ময়মনসিংহে) আগমন করেন ও পূর্ব ময়মনসিংহের শাসনভার গ্রহণ করেন। তার অধিকৃত কামরূপের অংশ দিয়ে নছরতের নতুন শাসিত প্রদেশ “নছরত ও জিয়াল” নামে পরিচিত লাভ করে। জরিপ ও গবেষণার তথ্য থেকে জানা যায় যে ইতিহাসে একই নামে দুই জন ব্যাক্তি রয়েছে – এ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়ায় সাধারণ মানুষ। ১৭৯১ ইং সালে পশ্চিম ময়মনসিংহে যিনি নাসিরাবাদ শহর গোড়াপত্তন করেন তার নাম ছিল তালুকদার নাসির উদ্দিন মোড়ল। শহর পত্তনের সময় তার অধিকাংশ জায়গা ইংরেজিদের নিকট দান ও বিক্রয় করেছিলেন। ফলে তার নাম দিয়ে নাসিরাবাদ শহর পত্তন হয়। তবে মোমেনসিং জেলার প্রধান শহর নাসিরাবাদ ১৯০৫ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
অধ্যাপক গোলাম সামদানী কোরায়শীর মতে, ময়মনসিংহকে বেসরকারিভাবে ’মোমেনশাহী’ লেখার প্রবণতা দেখা যায় বিভিন্ন ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এ প্রবণতার একমাত্র উদ্দেশ্য ময়মনসিংহ জেলার বিকৃতিকে সংশোধন করা। ১৮৪৪ সালে প্রকাশিত মানচিত্রে মোমেনসিং পরগনাসহ পশ্চিম ময়মনসিংহের শেহড়া, নাসিরাবাদ ও বাইগনবাড়ি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ স্থানের নাম, অবস্থান ও চিহ্নসহ উল্লেখ রয়েছে। তা ছাড়াও রেনেলের সব মানচিত্রগুলো দেখলে ও গবেষণা করলেই তা ময়মনসিংহের প্রাচীন ইতিহাস সহজে বোঝা যাবে।
গৌরীপুর উপজেলার অন্তর্গত বোকাইনগর ছিল মোমেনসিং পরগনার রাজধানী। ঈশা খাঁ সে সময় বোকাইনগরকে একটি শক্তিশালী সামরিক ঘাটি ও দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করেন। এই পরগনা অন্যান্য পরগনার চেয়ে অনেক বড় এবং একটি বৃহৎ জলদুর্গ ও দুটি প্রাসাদ দুর্গ থাকায় সামরিক ঘাটির জন্য বিখ্যাত ছিল। ঈশা খাঁর তৃতীয় শক্তিধর, বারভূঁইয়ার নবাব সমতুল্য জমিদার, মুঘল আমলের ইতিহাসখ্যাত তিনটি বইয়ের উল্লেখিত বীরযোদ্ধা আফগান হিরো খাজা উসমান খাঁ উত্তর উরিষ্যা থেকে বোকাইনগরে আসেন। ১৬০৯ সালে খাজা উসমান খাঁ বোকাইনগর ত্যাগ করার পর অত্র পরগনার সব কিছু মুঘলদের অধীনে চলে যায়।
বোকাইনগরে খাজা উসমান খাঁ ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন তার সময়ে নির্মিত সামরিক দুর্গ এবং রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে প্রধান কর্মকর্তা বা কানুনগোর জন্য প্রধান কার্যালয়ের স্থাপন, নদীর ধারে জল দুর্গ স্থাপন করা ইত্যাদি।কেদারনাথ মজুমদারের মতে, প্রাচীন জমিদার ও জমিদারী শাসনকালে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ হতে শাহ সুজা রীতিমতো বাংলার কর আদায় করতে আরম্ভ করেন। কানুনগো কার্যালয় : রাজস্ব ও জমা-জমির বন্দোবস্তের জন্য স্থানে স্থানে কানুনগুর কার্যালয় স্থাপিত ছিল। দশকাহনীয়ার (শেরপুর) অন্তর্গত দর্শা, মমিনসাহির (মোমেনসিং বা ময়মনসিংহ পরগনার) অন্তর্গত বোকাইনগর (গৌরীপুর) ও বড়বাজুর অন্তর্গত নালিপা নামক স্থানে তিনটি প্রধান কানুনগো কার্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। বাংলা ১৩১৫ সালে কলকাতায় জাহ্নবী ম্যাগাজিনে জমিদার শ্রীশৌরীন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর একটি লেখা ‘বোকাইনগরের ইতিবৃত্ত’ প্রকাশিত হয়েছিলো। এ দুর্লভ লেখাটির থেকে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো -” অধিবাসীগণ সমস্ত জঙ্গল কাটাইয়া স্থানটিকে চাষবাসের উপযোগী করিয়া তুলিতেছে; গ্রামের মধ্যস্থলে একটি প্রাচীন দুর্গের কঙ্কাল-চিহ্ন অদ্যাপি দৃষ্ট হয়। কোন সময়ে ইহা প্রথমে নির্মিত হয়, তাহা নির্ণয় করা সুকঠিন। তবে জনপ্রবাদ হইতে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, বঙ্গদেশে বারো ভূঁইয়ার বিদ্রোহানল প্রবল হইয়া উঠিলে দিল্লীশ্বর জাহাঙ্গীর খাজে ওসমান নামক জনৈক সেনাপতির অধীনে একদল মোগলসৈন্য প্রেরণ করেন বোধ হয়। এই খাজে ওসমান কর্তৃকই বর্তমান কেল্লার ভিত্তি স্থাপিত হইয়াছিল। রাজস্ব-নিরূপণ ভূমির বন্দোবস্তের জন্য একটি কাননগুর কার্যালয়ও এই সঙ্গে স্থাপিত হয়। মোগল অধিকারের পূর্বে এদেশে কোচ গারো প্রভৃতি পার্বত্য অসভ্য জাতি বাস করিত”
গৌরীপুরের প্রাচীন শহর ছিল বোকাইনগরের নিজামাবাদ:
ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার অন্তর্গত বোকাইনগরের নিজামাবাদ সাতশত বছরের অধিক নদী বন্দরকেন্দ্রিক শহর ছিল। তাছাড়া সুদূর অতীতে মোমেনসিং পরগনার রাজধানী হিসেবে বোকাইনগর প্রসিদ্ধ ছিল। বোকাইনগর ইউনিয়নে হযরত শাহ জালাল (রহঃ) এর সমসাময়িক হিসাব অনুযায়ী সাতশ’ বছর ধরে হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রহঃ) এর মাজার শরীফটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মাজারটি গৌরীপুর উপজেলা শহর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দক্ষিণে। হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রহঃ) এর নামানুসারে মুঘল আমলে নিজামাবাদ শহর প্রতিষ্ঠি হয়। ১৭৮৭ সালে ভূমিকম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের স্রোত দিক পরিবর্তিত হয়ে যমুনা নদী সৃষ্টি হলে পর্যায়ক্রমে নিজামাবাদ শহরটি ধ্বংস হয়ে যায় । বর্তমান নিজামাবাদ একটি বড় মৌজা। নিজামাবাদ মৌজার মাঝখানে ছোট ছোট মৌজা রয়েছে। ধারণা করা হয় ছোট ছোট মৌজাগুলো এক সময়ে পানির মধ্যে ছিল। যার ফলে মৌজাটি তিন-চার খণ্ডে বিভক্ত।
নিজামাবাদ মৌজার প্রথম খণ্ডের গ্রামগুলো হচ্ছে মোমেনপুর ও মামুদনগর। দ্বিতীয় খণ্ডের গ্রামগুলো হচ্ছে মিরাকান্দা, ত্রিশঘর ও মিরিকপুর। তৃতীয় খণ্ডের গ্রামগুলো হচ্ছে নিজামাবাদ, পাঠানটোলা, খাজান্দর। চতুর্থ খণ্ডের গ্রামগুলো হচ্ছে বাসাবাড়ি, কালীবাড়ি, বালুচড়া ইত্যাদি।
ইতিহাস অনুসন্ধান করে দেখা যায়, অনেকদিন আগে নিজামাবাদ জায়গাটি নদী বা জলাভূমি দ্বারা তিন-চারটি দ্বীপে পরিণত হয়েছিল। এর জন্য ভৌগোলিক অবস্থান সর্ম্পকে একটু আলোকপাত করা প্রয়োজন। একসময়ে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্রের প্রশস্ততা ছিল ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটারের মতো। এ প্রসঙ্গে জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্র কিশোর রায়চৌধুরীর কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো –“কেল্লার ভিতর দিয়া যে নদী প্রবাহিত হইত, তাহার উপরিস্থ একটি সেতুর ভগ্নাবশেষ এখনও বিদ্যমান রহিয়াছে। যে স্থানে উহা অবস্থিত সে স্থানে নদী এখন শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। সেতুটি প্রাচীন বলিয়াই বোধ হয়।……. উহার প্রায় তিন ভাগ ভূগর্ভে প্রোথিত হইয়া গিয়াছে। বিগত ভূমিকম্পে স্থানে স্থানে ফাটিয়া গেলেও উহার সুদৃঢ় নির্মাণপ্রণালী প্রশংসনীয়। মুসলমানাধিকারে আসিয়া বোকাইনগর শ্রীসম্পন্ন হইয়াছিল। কিল্লাদারের ও স্থানীয় অর্থশালী ব্যক্তিগণের উৎসাহে নানাবিধ শিল্পেরও বহুল উন্নতি হইয়াছিল। তৎকালে ওই স্থানের কাপড়, বেত্রের কারুকার্য ও নানাবিধ সুচিকার্য এ অঞ্চলে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করে। এখনও খলিফাপট্টি, লেনেপট্টি, তামাকপট্টি প্রভৃতি নাম পূর্ব গৌরবের পরিচায়ক, কয়েক ঘর তন্তুবায় অদ্যাপিও এখানে বস্ত্র বয়ন দ্বারা জীবিকানির্বাহ করিয়া আসিতেছে। বর্তমান সময়ে এ স্থানের পূর্ব শিল্প-গৌরব-বৈভব পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইয়াছে। ’’ ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স এর যৌথ উদ্যোগে আড়াইশ’ বছর আগে ব্রিটিশ ভূবিদ জেমস রেনেলের মানচিত্র সংগ্রহের মাধ্যমে মোমেনসিং পরগণার প্রাচীন নিদর্শন খোঁজার জন্য ২০২০ হতে জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়। জরিপকালীন গৌরীপুর শহর থেকে ৪/৫ কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক বোকাইনগরে নিদর্শন খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করা হয় ৮টি প্রাচীন নিদর্শন। ৮টি প্রাচীন নিদর্শনগুলো হচ্ছে – (১) হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রহঃ) এর মাজার (২) কেল্লা বোকাইনগর মাটির প্রাচীর (৩) বোকাইনগর শাহী মসজিদ (৪) প্রাচীন মঠ (৫) কালীবাড়ি মন্দির (৬) গোসাইবাড়ি মন্দির (৭) বাসাবাড়ি জমিদার বাড়ি (৮) মধ্যযুগের বেশ কয়েকটি মাজার শরীফ। এ অঞ্চল ছিল পাঠান রণনায়ক খাজা উসমানের শেষ ঘাঁটি। ইতিহাসখ্যাত খাজা উসমান খাঁর দুর্গ ও নিজামুদ্দীন মাজারের জন্য এ স্থান সমধিক পরিচিতি ও গুরুত্ব লাভ করেছে।
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর ময়মনসিংহে আগমন :
দত্ত ও নন্দীদের পতনের পর ব্রাহ্মণ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী মোমেনসিং পরগনার জমিদারির দায়িত্ব লাভ করেন। বোকাইনগরে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী আসার আগে দত্ত-নন্দী বংশীয়রা তখন নিজেদের মধ্যে আত্মবিরোধে আত্মহারা। পরগনার সম্পত্তির বিভাগ নিয়ে কেল্লা বোকাইনগরের শাসনকর্তার নিকট ৩/৪ জন অংশীদার আবেদনও করলেন। শাসনকর্তা নবাবকে জানাইলেন, “দত্ত-নন্দী বংশীয় জমিদারদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি হয়েছে, সম্পত্তির অংশীদারগণ নিজ নিজ স্বার্থ চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত। প্রজাদের নিকট হতে খাজনা আদায় করা হয়নি।” এই সুযোগে সিন্ধা পরগণার মুসলমান জমিদারও মোমেসিং পরগনার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য কেল্লা বোকাইনগরের শাসনকর্তার নিকট বারবার তদবির করেন। কিন্তু নবাব বিদ্রোহ দমনের পুরস্কারস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণকে মোমেনসিং পরগণার চৌধুরীই পদে প্রতিষ্ঠিত করলেন। জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্র কিশোর রায়চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থ থেকে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো – “শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরি ঐ বৎসর শ্রাবণ মাসে উপযুক্ত লোকজন সহ ময়মনসিংহ যাত্রা করিলেন। জমিদারি অধিকার বিষয়ে বিশেষ সহায়তা করার জন্য নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ কেল্লা বোকাইনগরে কর্মচারীর নিকট আদেশপত্র প্রদান করিলেন। কথিত আছে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরির সঙ্গে একশত নৌকা ও পাঁচশত লোক আসিয়াছিল। গৃহ প্রস্তুতের উপকরণাদি নৌকা যোগেই আনীত হইয়াছিল। লাঠিয়াল, পাইক, গোমস্তা, আমীন ও তহশীলদার প্রভৃতি জমিদারি সম্পৰ্কীয় লোক ব্যতীত নাপিত, ধোপা, ভাণ্ডারী, তহশীলদার, পুরোহিত প্রভৃতিও তাহার সঙ্গে আসিয়াছিল। নবাব কতকগুলি সিপাহি প্রেরণ করিয়া তাহার সহায়তা করিয়াছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরি দলবল সহ মহাসমারোহে ময়মনসিংহ উপস্থিত হইয়া কেল্লা বোকাইনগরের নিকটস্থ একস্থানে স্বীয় বাসাবাড়ি নির্মাণ করিতে আরম্ভ করিলেন; এবং বোকাইনগরের শাসনকর্তা ও নবাবি সৈন্যের সহায়তায় জমিদারি দখলের উদ্যোগ করিলেন।”
তথ্য সূত্রঃ (১) ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার – শ্রী শৌরীন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী (রামগোপালপুর এস্টেট এর জমিদার ও রাজা যোগেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ৩য় পুত্র) (২) ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ – শ্রী কেদারনাথ মজুমদার (৩) ময়মনসিংহের জমিদারি ও ভূমিস্বত্ব – মো. হাফিজুর রহমান ভূঞা (৪) ব্রিটিশ ভূবিদ মেজর জেমস রেনেলের অংকিত কয়েকটি মানচিত্র (৫) সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে – ভারত উপমহাদেশের অন্যতম কৃতী ইতিহাসবিদ ও প্রফেসর ড. অমলেন্দু দে (৬) নেত্রকোণা জেলার ইতিহাস – আলী আহম্মদ খান আইয়োব (৭) উইকিপিডিয়ার উল্লেখিত শিরোনামগুলো থেকে (ক) গৌরীপুর উপজেলা – উইকিপিডিয়া (খ) কলকাতা – উইকিপিডিয়া (৮) বাংলাপিডিয়া (৯) ম্যাগাজিন: পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স-২০২০, পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স-২০২১ ও ২০২২ (১০) ইতিহাস অনুসন্ধানী সংগঠন কর্তৃক প্রতিবেদন (এসিক এসোসিয়েশন, ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন ও দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স ) (১১) ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন – দরজি আবদুল ওয়াহাব (১২) ময়মনসিংহের রাজপরিবার – আবদুর রশীদ। (13) A Description Of The Roads In Bengal And Bahar and A General Map of the Roads in Bengal (14) The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760- Richard M. Eaton (15) The History of British India- James Mill (16) The history of two forts in Gouripur, Mymensingh ( An article published in the New Nation). (17) David Rumsey Historical Map Collection. (18) New York Historical Society. (19) The East-India Register and Directory for 1819 (Second Edition) collected from Harvard University, USA.