বোকাইনগরের প্রাচীন ঐতিহ্য: (পর্ব-২) বাসাবাড়ি জমিদারবাড়িতে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর ৮ম বংশধর পর্যন্ত জমিদারি
এক সময় কেল্লা বোকাইনগর ও কেল্লা তাজপুর বৃহত্তর ময়মনসিংহের মধ্যে অন্যতম দুইটি প্রধান স্থান ছিল। ধনে, জনে, ঐশ্বর্যে, সভ্যতায় এই দুই স্থানই তখন শ্রেষ্ঠ ছিল। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী বোকাইনগর দুর্গ বা কেল্লার উপকণ্ঠে বাসাবাড়ি এলাকায় তার বাসস্থান নির্বাচন করলেন। তবে বাসাবাড়ির ইতিহাস অনেক পুরোনো। যার প্রমাণ স্বরূপ বোকাইনগর ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা ও নিদর্শন দেখা যায়। বাসাবাড়ির পূর্ব নাম ছিল বাশঁবাড়ি যা কামরুপ শাসনামল হতে নামটি ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। পরবর্তী ব্রাহ্মণ জমিদারগণ বাশঁবাড়ি নামটি পরিবর্তন করে নাম রাখেন বাসাবাড়ি। ‘ বাসাবাড়ি ছিল ব্রাহ্মণ জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী কৃষ্ণ চৌধুরীর ২য় রাজবাড়ি’ যা এক সময়ে মোমেনসিং পরগণার প্রধান কানাগুর কাযালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। ৩০০ বছর আগে নির্মাণ করা জমিদার বাড়িটি এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইতিহাসে জানা গেছে ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার অন্তর্গত বোকাইনগর ইউনিয়নে বাসাবাড়ি নামে রাজবাড়িটি ১৭১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর ১ম বা প্রধান রাজবাড়িটি খোঁজার জন্য প্রাচীন মানচিত্র সংগ্রহ ও গবেষণার মাধ্যমে অনুসন্ধানের কাজ করছে এসিক এসোসিয়েশন , ক্রিয়েটিভ সন্ধানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্লাবসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন। সংগঠনের মাধ্যমে অজানাকে জানার জন্য ইতিহাসের অপ্রকাশিত অধ্যায়, তথ্যসূত্র, জনশ্রুতি, প্রাচীন মানুষের কথা, ঝরেপড়া অপ্রকাশিত তথ্য সংগ্রহ, প্রাচীন দুর্লভ তথ্য ও প্রাচীন মানচিত্র সংগ্রহ ও গবেষণার মাধ্যমে আপডেট ইতিহাস রচনা করা হয়ে থাকে। অনুসন্ধান করে জানা গেছে ছোট-বড় চারটি পরগনার জায়গিদার রাজা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর পৈত্রিক রাজবাড়িটি বগুড়ার আদমাদিঘী উপজেলার অন্তর্গত কড়ই গ্রামে অবস্থিত । ১৭৫৭ কিংবা ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে কড়ই গ্রামে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মৃত্যুর পর রাজবাড়িটি জনশূন্য হয়ে যায়। প্রায় ৪০০ বছরের কয়েকটি পুরনো ঐতিহাসিক ধ্বংশাবশেষ এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গৌরীপুরের রামগোপালপুরের জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী তার জীবদ্দশায় অর্থাৎ শত বছর আগে কড়ই গ্রামে তৎকালীন জমিদারদের সুবৃহৎ বাসভবনের ভগ্নাবশেষ বিপুল সমৃদ্ধির পরিচয় দিচ্ছিল। গবেষণায় দেখা গেছে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর দুই তরফের চার ছেলে ফকির মজনু শাহ-এর অত্যাচার ও বিদ্রোহী জমিদার মীর সাহেবের শত্রুতাবশত বগুড়ার আদমদিঘীর কড়ই গ্রাম ত্যাগ করে জামালপুর জেলা অন্তর্গত জাফরশাহী পরগনার কৃষ্ণপুর গ্রামে (বর্তমান জেলা শহর) তরফ রায়চৌধুরীর রাজপরিবার এবং মালঞ্চ গ্রামে (বর্তমান মেলান্দহ উপজেলায়) তরফ চৌধুরীর রাজপরিবার বসবাস করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বংশের একটি শাখা যেমন তার কনিষ্ঠ ছেলে লক্ষীনারায়ণ ও লক্ষীনারায়ণের তিন ছেলে শ্যামচন্দ্র, গোবিন্দ চন্দ্র ও রুদ্রচন্দ্র গৌরীপুরের বোকাইনগর কেল্লার উপকন্ঠে ঐ বাসাবাড়িতে বাস করে পূর্বপুরুষের বাসস্থান নির্বাচনের গৌরব অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন
পরবর্তীতে বোকাইনগর বাসাবাড়ি এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরী
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর দ্বিতীয় তরফ চৌধুরীর হিস্যার সম্পত্তি সমান দু’ভাগে বিভক্ত হওয়ার পর বোকাইনগর বাসাবাড়ি এস্টেট বা জমিদারির মালিক ছিলেন লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরীর তিন ছেলে। ১৭৭০ সালে জামালপুর সদর হতে দত্তক ভ্রাতুষ্পুত্র যুগলকিশোর রায় চৌধুরী মোমেনসিং পরগনার এজমালি সম্পত্তির গৌরীপুর রাজবাড়িতে চলে আসার আগে লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরী জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার অন্তর্গত মালঞ্চ রাজবাড়ি ত্যাগ করে গৌরীপুরের বোকাইনগরে অবস্থিত পিতার নির্মিত বাসাবাড়িতে চলে আসেন। পরবর্তীতে এই বাসাবাড়ি হতে আরো তিনটি রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়।
লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরীর মৃত্যুর পর শ্যামচন্দ্র, গোবিন্দচন্দ্র ও রুদ্রচন্দ্র তিন ছেলে পিতার সম্পত্তির অধিকারী হয়ে কিছুদিন একত্রে ছিলেন। পরে ভ্রাতৃবিরোধ ও আত্মকলহে এই পরিবারের বন্ধন পৃথক হয়ে যায়। শ্যামচন্দ্র চৌধুরী পৃথকভাবে বাসাবাড়ির কাছেই বাসস্থান তৈরি করে বসবাস শুরু করেন। গোবিন্দচন্দ্র চৌধুরী বোকাইনগর বাসাবাড়ি হতে দুই কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত গোলোকপুর স্থানে বাসস্থান তৈরি করে চলে আসেন। রুদ্রচন্দ্র চৌধুরী বাসাবাড়িতেই রইলেন।
বোকাইনগর বাসাবাড়ির জমিদার রুদ্রচন্দ্র চৌধুরী
হরচন্দ্র ও ভৈরবচন্দ্রের বিভাগ :
রুদ্রচন্দ্র চৌধুরীর মৃত্যুর পর উভয় ভ্রাতা হরচন্দ্র চৌধুরী ও ভৈরবচন্দ্র চৌধুরী কিছুদিন একত্রে ছিলেন। পরে ভ্রাতৃবিরোধ ও আত্মকলহে এই পরিবারের বন্ধন পৃথক হয়ে যায়। ভৈরবচন্দ্র চৌধুরী ১আনা ৬ গন্ডা ২ কড়া ২ ক্রান্তি অংশ প্রাপ্ত হয়ে বাসাবাড়ির হতে আধা কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ভবানীপুর গ্রামে বাসস্থান তৈরি করে চলে আসেন। হরচন্দ্র চৌধুরী ১ আনা ৬ গন্ডা ২ কড়া ২ ক্রান্তি অংশ সম্পত্তির অধিকার প্রাপ্ত হয়ে বাসাবাড়িতেই রইলেন। হরচন্দ্র চৌধুরী খুব অমিতব্যয়ী ও বিলাসপ্রিয় জমিদার ছিলেন। তিনি বুদ্ধিমান হলেও জমিদারি কাজে অলস প্রকৃতির ছিলেন।। সম্পত্তি রক্ষার জন্য তার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু চেষ্টা ছিল না। জমিদারির পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ছিলেন। নিজে জমিদারির কাজে নবাবের মত পরিদর্শন করতেন, কিন্তু কর্মচারীগণই জমিদারির একমাত্র কর্ণধার বা কান্ডারী ছিল। আয় ব্যয় যে কিরূপ তা তিনি জানতেন না। বহু দূর থেকে নর্তকী ও গায়িকা আনা হতো, তাতে তার অনেক অর্থ ব্যয় হতো। এরূপ কথিত আছে যে, প্রতি বছর শারদীয় দুর্গা পূজা ও কালীপূজা উপলক্ষে বন্য মহিষ ধরে বলি দেওয়া হতো। তিনি এরূপ অসাধারণ ছিলেন যে, বন্য মহিষ ধরে আনা হলে তিনি একাই তাকে স্নান করিয়ে উৎসর্গার্থে নিয়ে যেতেন। তার হাত থেকে বন্য মহিষ মুক্তিলাভ করার জন্য বল প্রয়োগ করেও অকৃতকার্য হতো।
হরচন্দ্র চৌধুরীর উদ্ভূত বিলাসিতার দৃষ্টান্ত :
হরচন্দ্র চৌধুরী একটি বিস্তৃত বাগান তৈরী করে তাতে ফজলি, নেংড়া প্রভৃতি সুমিষ্ট আমের বৃক্ষ রোপণ করিয়েছিলেন। বৃক্ষ রোপণ করিয়ে দশ পনের দিন পর পর আবার তা তুলিয়ে দেখতেন যে ইহার মূল কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়েছিল। এইরূপে বার বার তুলিয়ে দেখার কারণে বৃক্ষ বিনষ্ট হয়ে যেতো। আম ফলের মিষ্টি বাড়ানোর জন্য তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা হতে নৌকা যোগে মৃত্তিকা আনাইতেন। ময়মনসিংহের মাটিতে আম ফল ভাল হয় না এবং অধিকাংশ আমের মধ্যে পোকা জন্মে এই জন্য দূরদেশ হতে মাটি এনে বাগান পূর্ণ করেছিলেন। তার বিলাসিতা সম্বন্ধে আরও অনেক প্রবাদ প্রচলিত আছে। তার অনেক পালিত হাতী ছিল, সেই সকল হাতীকে তিনি স্বর্ণ রৌপ্যের অলঙ্কার দ্বারা ভূষিত করতেন। যদি তা কোথাও পিছলে পড়ে গেলে অথবা অলঙ্কারসহ হাতী পালিয়ে যেত, তা হলে তিনি পুনরায় অলঙ্কার পাওয়ার চেষ্টা করতেন না, এর পরিবর্তে নূতন অলঙ্কার তৈরী করে দিতেন। তিনি বলিতেন, “হস্তীর দেহ ভ্রষ্ট অলঙ্কার দরিদ্রের প্রাপ্য।” জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায়চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থে বোকাইনগর বাসাবাড়ির সংক্ষিপ্ত বিবরণের কথা উল্লেখ রয়েছে। জমিদার হরচন্দ্র চৌধুরীর সম্বন্ধে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো- “তাহার পুষ্করিণীতে যে সমস্ত রুই, কাতলা, মৎস্য ছিল তাহাদের নাকে তিনি স্বর্ণ নির্মিত নথ পরাইয়া দিয়াছিলেন। তাহার পুষ্করিণীতে কেহ মাছ ধরিতে পারিতেন না, এমনকি স্নানও করিতে পারিতেন না। তাহার বাটির নিকটে যে সমস্ত ভূমি ছিল সেই সকল ভূমির আল তিনি কাটা কম্পাস দ্বারা ঠিক সোজা করিয়া দিতেন। ওই সমস্ত জমি এখনও দৃষ্টিগোচর হয়। বাঁশের ঝাড়ও ছাঁটিয়া কাটিয়া সুদৃশ্য করিতেন। নিজের পরিচ্ছদাদির পারিপাট্যও যথেষ্ট ছিল। তিনি বহুমূল্য বস্ত্রই পরিধান করিতেন, সাধারণ লোকের ব্যবহার যোগ্য বস্ত্রাদি কিছুতেই পরিধান করিতেন না। নিজের বাসগৃহটি বহুদিনের চেষ্টায় অতি সুন্দররূপে গঠিত করিয়াছিলেন। এরূপ শুনা যায় যে, গৃহটি ক্রমে আট দশ বার ভাঙিয়া তৎপর মনোমত করিয়াছিলেন।”
ময়মনসিংহ পরগনা ও জাফরশাহী পরগনায় ভিন্ন পরগনার জমিদারগণের প্রবেশ ও অধিকার লাভ :
হরচন্দ্র চৌধুরীর এত অপব্যয়, ঋণ তার নিত্য সহচর। অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের কারণে হরচন্দ্র অচিরেই ঋণের জালে জড়িয়ে পড়লেন এবং ঋণ পরিশোধের নিমিত্ত সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রয় করতে বাধ্য হলেন। তখনকার সময়ে ময়মনসিংহ ও জাফরশাহী পরগণাতে শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বংশধর ব্যতীত অন্য কোন পরগনার জমিদারদের ভূমি বা তালুক অথবা মৌজার অধিকার ছিল না; কিন্তু হরচন্দ্র চৌধুরীর বিক্রিত জমিদারি ক্রয় করলে ভিন্ন পরগণার জমিদারগণ ময়মনসিংহ পরগনা ও জাফরশাহী পরগনায় কিছু ভূমির মালিক অধিকার লাভ করেন।
হরচন্দ্রের পারিবারিক অবস্থা , সৎকার্য ও পরলোক গমন :
মহাসমারোহে শৈলপাড়ান নিবাসী রামসুন্দর চক্রবর্তীর মেয়ে জয়দুর্গা দেবীর সঙ্গে হরচন্দ্র চৌধুরীর বিয়ে সম্পন্ন হয়।
তার গর্ভে রামচন্দ্র ও কালীশ্চন্দ্র নামক দুই পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। পিতার জীবিতকালেই কালীশ্চন্দ্র অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হন। জমিদার হরচন্দ্র চৌধুরীর একমাত্র পুত্র রামচন্দ্র চৌধুরীর বিবাহ অতি ধুমধামের সাথে সম্পাদন করেন। দেশ বিদেশের বহু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত রামচন্দ্র চৌধুরীর বিবাহে আমন্ত্রিত হয়ে হয়েছিলেন। হরচন্দ্র চৌধুরী ছিলেন উদার ,উচ্চমনা, নম্র এবং বিনয়ী। তিনি যদিও অপব্যয়ে বহু অর্থ ব্যয় করতেন কিন্তু সৎকার্যে ও সদনুষ্ঠানে তিনি কৃপণতা প্রকাশ করতেন না। অতিথি সমাদর ও দীন দরিদ্রকে দান তার স্বভাবসিদ্ধ গুণ ছিল। হরচন্দ্র চৌধুরী একমাত্র পুত্র সন্তান রামচন্দ্রকে রেখে যথাসময়ে পরলোক গমন করেন।
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বংশের পঞ্চম পুরুষ রামচন্দ্র চৌধুরীর সংযত জীবনযাপন ঃ
হরচন্দ্র চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার একমাত্র পুত্র রামচন্দ্র চৌধুরী পিতৃত্যক্ত সম্পত্তির ওপর অধিকার লাভ করেন। পিতার ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে রামচন্দ্র চৌধুরী ধীরগতিতে জমিদারি কাজে যোগ দিলেন। তিনি বুদ্ধিমান, ন্যায়নিষ্ঠ, শ্রমপটু ও কর্ম-কুশল ছিলেন। খরচ কমিয়ে মিতব্যয়ী হওয়ার পরেও তিনি উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারেন নাই। পিতার ঋণের বোঝা তার উন্নতির প্রধান অন্তরায় হয়েছিল। ঋণ পরিশোধেই তার সমস্ত শক্তি, শ্রম ও কর্মজীবন ফুরিয়ে গিয়েছিল
রামচন্দ্র অতিশয় ধর্মনিষ্ঠ ও শান্তিপ্রিয় জমিদার ছিলেন। লোকের দুঃখ দুর্দশা দেখলে তিনি তাদের প্রতি বড়ই স্নেহশীল, বড়ই দয়ালু ছিলেন। তার বিনয় ও অমায়িকতার গুণে তিনি অল্পদিন মধ্যেই জনগণের বিশেষ প্রীতিলাভ করেছিলেন। রামচন্দ্রের দেহ অতিশয় বিশাল ও বলিষ্ঠ ছিল। তার শারীরিক শক্তি সম্বন্ধে অনেক প্রবাদ বাক্য প্রচলন রয়েছে।
রামচন্দ্র চৌধুরীর পারিবারিক অবস্থা ঃ
রামচন্দ্র চৌধুরী প্রথমে বেগুনবাড়ি গ্রামে মহেশ্বরী দেবীকে বিবাহ করেন। মহেশ্বরীর গর্ভে মহেন্দ্রচন্দ্র নামক এক পুত্র সন্তান জন্ম হলে তিনি অকালে পরলোকগমন করেন। তারপর রাজশাহী জেলার অন্তর্গত উদিশাগ্রামে বামাসুন্দরী দেবীকে বিবাহ করেন। বামাসুন্দরী দেবী ধার্মিক ও বুদ্ধিমতী ছিলেন। তার গর্ভে শ্রীশচন্দ্র নামক এক পুত্র এবং কমলকামিনী দেবী ও শরৎকামিনী দেবী নামক দুই কন্যা জন্মগ্রহণ করে। সতীশচন্দ্র সান্যালের সঙ্গে কমল কামিনী দেবীর ও হরিদাস লাহিড়ির সঙ্গে শরৎকামিনী দেবীর বিবাহ হয়। জমিদার রামচন্দ্র চৌধুরী দুই পুত্র ও দুই কন্যা রাখে ইংরেজি ১৮৮৪ সনের জানুয়ারি মাসে এবং বাংলা ১২৯০ সনের ২২ মাঘ অতি সজ্ঞানে ইহলোক ত্যাগ করেন।
রামচন্দ্রের পুত্রদ্বয়ের জমিদারি প্রাপ্তি এবং জ্যেষ্ঠ মহেন্দ্রচন্দ্রের পারিবারিক অবস্থা ও মৃত্যু :
রামচন্দ্র চৌধুরীর মৃত্যুর পর মহেন্দ্রচন্দ্র চৌধুরী ও তার সৎ ভাই শ্রীশচন্দ্র চৌধুরী পিতৃ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে -অল্পদিনের মধ্যেই পৃথক হলেন। মহেন্দ্রচন্দ্র গম্ভীর এবং ইংরেজি ভাষায় অধিকারী ছিলেন। তিনি প্রথমে সুরসুন্দরী দেবীকে বিবাহ করেন। কিন্তু সুরসুন্দরী নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোকগমন করলে মহেন্দ্রচন্দ্র চৌধুরী দুর্গাকান্ত মজুমদারের কন্যা হেমলতা দেবীকে বিবাহ করেন। এই বিবাহের অল্পদিন পরেই কলকাতা গমন করেন এবং সেখানে বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে বাংলা ১৩০২ সনের ৪ বৈশাখ (ইংরেজি ১৮৯৬ সনের ১৮ এপ্রিল) মাসে ইহলোক ত্যাগ করেন। জমিদার শ্রী শৌরীন্দ্র্রকিশোর রায়চৌধুরীর ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার’ গ্রন্থে বোকাইনগর বাসাবাড়ির সংক্ষিপ্ত বিবরণের কথা উল্লেখ রয়েছে। হেমলতা দেবীর সম্বন্ধে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো- “হেমলতা দেবীই এক্ষণে বাসাবাড়ির সম্পত্তির একাংশের উত্তরাধিকারিণী হইয়া বাস করিতেছেন।”
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বংশের ষষ্ঠ পুরুষ বাসাবাড়ির জমিদার শ্রীশচন্দ্র চৌধুরী ঃ
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বংশের ষষ্ঠ পুরুষ ও বাসাবাড়ির জমিদার কনিষ্ঠ শ্রীশচন্দ্র চৌধুরী বাংলা ১২৬৬ ( ইংরেজি ১৮৬০) সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অতি অল্প বয়সেই ইহলোক ত্যাগ করেন। পিতার মৃত্যুর পর বড় ভাই মহেন্দ্রচন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে পৃথক হয়ে জমিদারির কাজে যোগ দিলেন।, কিন্তু প্রথম যৌবনেই তার জীবনগ্রন্থি শিথিল হয়ে ছিন্ন হয়ে গেল। তিনি ক্ষণিক সময়ে সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন সুতরাং কার্যক্ষেত্রে বিশেষ পরিচয় দিতে পারেননি। তিনি বেতকান্দি নিবাসী নবকুমার ভট্টাচার্যের কন্যা ভুবনেশ্বরী দেবীকে বিবাহ করেন। তার একমাত্র পুত্র বীরভদ্রচন্দ্র চৌধুরী যখন বয়স তিন বৎসরের, সেই সময় শ্রীশচন্দ্র চৌধুরী পুত্রের স্নেহ-মমতা ত্যাগ করে ১২৯১ সালের ২২ ভাদ্র ( ইংরেজি ১৮৮৫ সালে) পররোকগমন করেন।
শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বংশের ৭ম পুরুষ ও বাসাবাড়ির জমিদার বীরভদ্রচন্দ্র :
বীরভদ্রচন্দ্র চৌধুরী ১২৮৯ সালের ৪ পৌষ ( ইংরেজি ১৮৮২) সোমবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শৈশব অবস্থায় পিতৃহীন হয়ে মাতা ও পিতামহীর (ঠাকুরমার) তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হতে লাগলেন। প্রথমত গৃহ-শিক্ষকের নিকট তার শিক্ষা আরম্ভ হয়। বীরভদ্রচন্দ্র অভিভাবকহীন ও পিতামহী ও মাতার নয়নের মণিস্বরূপ ছিলেন। শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে তার উপর কোন শাসন ছিল না, সামান্য দোষের আরোপও হতো না। এইরূপ অত্যধিক আদরে ও স্নেহে অনেক বালককে এরূপ শিক্ষায় লাই বা সময়ের অপচয়ের সুযোগ দিলে তা আমোদ, জুয়া,মদ্য বেশ্যা, নৃত্য, গীত, ক্রীড়া ইত্যাদির ক্ষেত্রে নিমগ্ন হতে পড়ে, কিন্তু বীরভদ্রচন্দ্রের পক্ষে ইহার বিপরীত ফল হল। তিনি বাল্যকালে স্বভাবতই ধীর, ও চিন্তাশীল ছিলেন। আত্মোন্নতি লাভের জন্য তার উদাসীনতা বা আলস্য মাত্র ছিল না। সমস্ত অসুবিধা দূরে রেখে তিনি আত্ম-চেষ্টায় ময়মনসিংহ জেলাস্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান হতে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা (এন্ট্রান্স) পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা কলেজে পড়তে আরম্ভ করেন। পর্যাক্রমে তিনি এফ এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বি এ পরীক্ষা পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন। তাতে নানা সমস্যার কারণে তিনি সফল হতে পারেননি।
চিত্র বিদ্যায় বীরভদ্রচন্দ্রের বিশেষ অনুরাগ ও শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর বংশের ৮ম পুরুষদের অনুসন্ধানঃ: