স্বরণীয় মরমী বাউল সাধক উকিল মুন্সি ১৩৮তম জন্মবার্ষিকী ১১ইজুন।
বৃহত্তর ময়মনসিংহের পূর্ব অঞ্চলের নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী উপজেলায় ধনুনদীর পশ্চিম পাড়ে নূরপুর বৌয়ালী মাজের পাড়া গ্রামে ১৮৮৫সালে ১১ইজুন ধনাঢ্য এক মুসলিম পরিবারে উকিল মুন্সি জন্ম গ্রহণ করেন।
উকিল মুন্সির আসল নাম হচ্ছে আবদুল হক আকন্দ বাবার নাম হলো গোলাম রসুল আকন্দ, মাতার নাম হচ্ছে উকিলের নেছা। মা-বাবা আদর করে ডাকতেন উকিল, কারণ ছেলে লেখা পড়া করে বড়ো হয়ে একদিন উকিল হবে। এই সুবিধার্থে উকিল নামে পরিচিত কিন্তু মুন্সি হচ্ছে তিনি ছোট কালে পড়া শুনা করেছেন মাদ্রাস, তখন উকিল মুন্সির বাবা,গৃহশিক্ষক তিনজন বাড়িতে রেখে ছেলেকে পড়াইতে। উকিল মুন্সি ছোট কালে তার কন্ঠে গান গজল গাইতেন খুব মধুর সুরে। উকিল মুন্সির বয়স যখন দশবছর তখন তার বাবা মারা যান বাবা মারা যাওয়ার পর তার ছোট ভাই আবদুল মজিদ বাড়িতে এই দিকে উকিল মুন্সি কিছুতে তার মন বসেনা পড়াশুনা বাবা কে হারিয়ে তখন উকিল মুন্সীর মা ও ছোট ভাই কে নিয়ে তার বাবার এক মাত্র বোন কিশোরগঞ্জ জেলা ইটনা উপজেলায় বিবাহ হোন সেখানে উকিল মুন্সির মাতা উকিলের নেছা দুই ছেলে নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে চলে যায়। ঐ উপজেলা উকিল মুন্সির ফুফুর বাড়িতে সেখানে মাত্র তিনবছর থাকেন কিন্তু ফুফুর সংসারে পড়াশুনা করতে পারেনি।তারা দুই ভা তখন ভাটি বাংলার কবিয়াল ও জারি গানের প্রচলন চলছে ঐ অঞ্চলে উকিল মুন্সি প্রতি রাতে ঐ গানে যোগ দিতেন স্রোতা হিসেবে পরে তিনি নিজে মঞ্চে গান গাইতেন।খুব তাড়াতাড়ি তিনি একজন কবিয়াল গানে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস তারা দুই ভাই আবার চলে আসেন গ্রামের বাড়ি নূর পুর বৌয়ালী মাজের পাড়া গ্রামের পৈতৃক নিবাসে আসলে কিছু দিনের মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে উকিল মুন্সি মা মদন উপজেলার বাগমারা বালালী গ্রামের এক যুবকের সাথে বিয়ে হয়ে যায়। তখন তার ছোট ভাই আবদুল মজিদ আকন্দ কে আটপাড়া উপজেলার হাতিয়ার তারা চাপুর গ্রামের এক আত্মীয় বাড়িতে পাঠিয়েদেন। এই দিকে উকিল মুন্সী তার বাবার ফুফা তো ভাই কাজী আলিম উদ্দিন মোহনগঞ্জ উপজেলার জালাল পুর গ্রামের থাকেন , থাকা অবস্থা তার ভাই আবদুল মজিদ আকন্দ মারা যান, সেখানে উকিল মুন্সি বেড়াতে যান, যাওয়ার পর ধনুনদী পার হওয়ার সময় লবুহোসের সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় সেখান থেকে তিনি লাবুসের মা হামিদা খাতুনের প্রেমে পড়েন সিদ্ধান্ত নেন বিবাহ করবেন কিন্তু এই দিকে তার চাচা কাজী পরিবার বিষয়টা জানা জানি হয় তখন তার চাচা বলে আমার বাড়ির চার সীমানা যাতে তাকে না দেখি। তারপর উকিল প্রেমে পরে একটি গান লিখেছেন ধনুনদীর পশ্চিম পাড়ে ঐ দেখা যায় সোনার জালালপুর ঐ খানে বাস করে উকিলের মন চোর গাগলাজুর, জালালপুর, শ্যামপুর, জৈনপুর, পাগলের মতো ঘুরতে থাকেন, কিছুতে তার চাচা রাজি না লবুহোসেন সাধারণ কৃষক আর কাজী আলিম উদ্দিন সম্ভান্ত্র পরিবার। উকিল মুন্সি আবার সেই খালিয়াজুরীতে বাবার আত্মীয় সজন কে বলেন হামিদা খাতুন কে বিয়ে করবেন কিন্তু কেউ রাজি হোন না এই বিবাহ বিষয়ে এইভাবে চলছে তার প্রেম জৈনপুর গ্রামে রাতে সে দেখা করে হামিদা খাতুনের সাথে এই দিকে উকিল মুন্সি হাওরে দক্ষিণে বরান্তর গ্রামে মসজিদে ইমাম থাকার দায়িত্ব নিলেন দিনে নামাজ পড়ান রাতে এশার নামাজের পর তিনি ধনুনদীর পারে বসে গান গজল গাইতেন ও লিখতেন।একদিন উকিল মুন্সি বিরুদ্ধে নালিশ দিলেন মোহনগঞ্জে থানা পুলিশের কাছে কিন্তু মঞ্চে গান শুনে উকিল মুন্সীর মুরিদ সেই পুলিশ। আর হামিদা খাতুনের সাথে কথা ও দেখা হতো প্রতিদিন উকিল মুন্সি প্রেম হয় ১৯১৫ সালে বিবাহ আবদ্ধহোন ১৯১৬সালে গোপনে তার লবুহোস মেয়ের বা পঞ্চাশ শতক জমি লিখে দেন তাদের নামে তার উকিল মুন্সি তার বাবার যত জমি ছিল সব বিক্রি করেন পানির দামে পৈতৃক গ্রামের। এক বারে চলে যান মোহনগঞ্জ জৈনপুর গ্রামে।উকিল মুন্সির প্রথম সন্তান আসে ১৯১৮সালে নাম রাখেন আব্দুস সাত্তার। তার উকিল মুন্সীর আরো তিনজন সন্তান হয় মেয়ে দুই জন সন্তোষ বেগম ও রাবেয়া খাতুন আরেক ছেলে পুলিশ মিয়া।
তিনি স্হায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন কিন্তু কিছু দিন যাওয়ার পর তিনি চলে আসেন মদন উপজেলার কুলিয়াটি গ্রামের মজিদের ইমাম থাকার জন্য। কুলিয়াটিগ্রামের ইমাম থাকার পর তিনি ছেলে মেয়েদেন মক্তবে কোরআন শিক্ষাদেন তার সাথে সাথে গান গজল গাইতেন লিখতেন কিন্তু বাউল জগতে যাননি কুলিয়াটি গ্রামের থাকা অবস্থা আবদুল আজিজ নেওয়াজী তার কাছে ইসলামী গান গজল শিখতে তালিম নিতেন। পরে পালগাঁও মসজিদে ইমাম হিসেবে চলে আসেন তখন মোহনগঞ্জ উপজেলার চানখা পাঠান জিটকির তার মাধ্যমে নেত্রকোনা সদর বাউল সাধক ওস্তাদ রসিদ উদদীন এর কাছে বাউল গানের তালিম নেওয়ার জন্য যান তার সঙ্গে সেখানে কিন্তু বাউলের আসর জমছে নেত্রকোনা পূর্ব ধলা লেটির কান্দা ফকির বাড়ি। উকিল মুন্সি যখন বাউল গান শিখেন তখন তার সঙ্গে ছিল মদনের রবি দাস আর জালাল খাঁ সিলেটের শাহ আব্দুল করিম। তিনি মালজোড়া টপ্পা পালা গান গাইছেন সিলেট সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ হবিগঞ্জ তাছাড়া নেত্রকোনা ময়মনসিংহ শহরে তিনি পালগাঁও মসজিদে ইমাম থাকা বার হারট্রা চন্দ্র পুরের খাজা চিশতিয়া তরিকা যিনি চলে যেতেন মোহনগঞ্জে পালগাঁয়ে গান শুনার জন্য আর উকিল মুন্সি একের পর এক গান তিনি গেয়ে যাচ্ছেন অনবরত মসজিদে বসে। তারা আবার চলে যান মদন উপজেলার কুলিয়াটি গ্রামের মজিদের সেখানে গিয়ে তিনি সিলেট হবিগঞ্জ রিসিদরবার শরীফরে সৈয়দ মোজাফফর কাছে পীরের মুরিদ হোন, মুরিদ হওয়ার পর তিনি কুলিয়াটি গ্রামের বাউলের শিষ্য তৈরি করেন প্রথম শিষ্য নুরুল ইসলাম ফকির, হান্নান, হৃদয় মাঝি,তিনি মসজিদে নামাজ পড়াইতেন আরেক দিকে গান ও গজল গাইতেন মসজিদে বারান্দায় তিনি যতে গান গাইছেন সব গান বিরহী ও বিচ্ছেদ উকিল মুন্সির মা বাবা একটি মসজিদ তৈরি করেছিলেন তার নিজ গ্রামে এখনো এই মসজিদটি নূরপুর বৌয়ালী মাজের পাড়া গ্রামে অবস্থিত। উনি ঐ মসজিদে নামাজ পড়াইতেন প্রতিবছর ঈদের সময় তাছাড়া ইমাম হিসেবে থেকেছেন। উকিল মুন্সি আটটি মসজিদে ইমাম ছিলেন, উকিল মুন্সী যখন গান গাইতেন তখন তার ছিল শুধু একতারা বা ছটি বাজিয়ে মঞ্চ কাঁপাতেন উকিল মুন্সী গান শুনে স্রোতা বন্ধুরা অঝোরে কাঁদতেন।
একজন লিপির ছিল মদনের দৈলত পুরের তিনি মঞ্চে গান গাওয়ার সময় লিখতেন সেই দৌলত পুর গ্রামের মাষ্টার। তাছাড়া নূরুল ইসলাম ফকির দুই শ উপরে গান মুখস্ত ছিল। উকিল মুন্সি ১৯৩০সাল থেকে ১৯৬০পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন মঞ্চে গান গেয়েছেন তার পর ১৯৭০ দিকে তিনি গান ছেড়ে দিয়েছেন বয়সের কারণে তার পর তিনি জৈনপুর গ্রামের মসজিদ ও জালালপুর ও শ্যামপুর আসে পাশে গ্রামের মসজিদে ইমাম হিসেবে ছিলেন।উকিল মুন্সি কিছু উল্লেখ্য যোগ্য গান :- আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে, সোনা বন্ধুয়া রে এতো দুঃখ দিলি আমারে, নবীজির খাশ মহলে, আমার গায়ে যত দুঃখ সয়,উকিল মুন্সি ওস্তাদ রসিদ উদদীন এর গান সোয়া চাঁন পাখি, উকিল মুন্সী বিখ্যাত গান হিসেবে পরিচিত হোন, ১৯৯৯সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ুন আহমেদ শ্রাবণ মেঘের দিন ছবিতে ললিতা কন্ঠে মমতাজ বেগম এর মাধ্যমে সুজন বন্ধু রে কোন বা দেশে থাক আমারে কান্দায়া কোন নাড়ীর মন রাখ সুজন বন্ধু রে, আর বংশীবাদক বারী সিদ্দিক মাধ্যমে ছয়টি গান গাওয়ালেন, তারপরিচিত লাভ করেন, উকিল মুন্সি জৈনপুর গ্রামের বেতাই নদীর পাড়ে বসতি স্থাপন করে জীবন যাপন করেন, উকিল মুন্সী কে নিয়ে লোক সংস্কৃতি গবেষক ওলেখক অমেলন্দ কুমার দাস জীবনি গান সংগ্রহ করে লিখেছেন, তাছাড়া কবি মাহবুব কবির বই লিখেছেন দুই জন জীবনী গান সহ লিখেছেন।
উকিল মুন্সি স্ত্রী হামিদা খাতুন প্রথম মারা যান তার পর ছেলে সাত্তার মুন্সি মারাযান এইসুখে তিনি কাতর হয়ে ১৯৭৮সালে ১২ডিসেম্বর মাসে ৯৩নম্বই বছরে ভক্ত বৃন্দ সবাই কে কাঁদিয়ে চিরনিদ্রায় বেতাই নদীর পাড়ে শায়িত হোন।
উকিল মুন্সী বিখ্যাত একজন বাউল সাধক শুধু ছিলেন না তিনি সুফি দরবেশও দার্শনিক তিনি মৃত্যুর আগপর্যন্ত শরিয়ত মোতাবেক চলাফেরা করেছেন,তিনি একাধারে মসজিদের ইমাম আবার গায়ক পেশা বাউল পরিচিতি গীতি কবি গীতিকার তিনি নিজে গান লিখতেন মসজিদে বসে আবার সুর দিতেন, হাওরে নাড়ীর বর্ষা দিনে যে রুপ দ্বারা সেটি তার গানের মাঝে ফুটিয়ে তুলেছেন সেই গানে
উকিল মুন্সির স্মৃতিকেন্দ্র – ২০১৭ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিনিয়র সচিব জনাব সাজ্জাদুল হাসান স্যারের উদ্যোগে মোহনগঞ্জ আদর্শনগর কলেজে “উকিল মেলা” অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাউল ভক্তরা অংশগ্রহন করেন।
বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে উকিল মুন্সির স্মৃতিরক্ষা এবং সমাধিস্থল সংরক্ষণের জন্য ২০২০ থেকে কাজ শুরু হয়েছে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে জৈনপুর গ্রামে স্মৃতি সমাধি, ব্রিজ, সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ সহ নানা কাজের জন্য ২৮ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। উকিল মুন্সির সমাধিস্থলে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে দুটি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়।
এর ফলে দেশ-বিদেশের বাউল ভক্ত, গবেষক, লেখকরা উকিল মুন্সির সংগ্রহশালায় বাউল চর্চার জন্য এখানে সহজে আসতে পারেন।গুনী শিল্পী মরমী বাউল উকিল মুন্সির ১৩৮ তম জন্মদিনে শ্রদ্ধা ভরে স্মরন করছি।