গৌরীপুরে মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন বোকাইনগর শাহী জামে মসজিদ
ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায় রয়েছে শতাব্দীর প্রাচীণ ইতিহাস । এ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পুরাকীর্তি । নিম্নে একটি পুরাকীর্তির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হল।
ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার বোকাইনগর শাহী জামে মসজিদ। প্রায় চারশ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক মসজিদটি স্থানীয়ভাবে ঐতিহ্যবাহী কিল্লা বোকাইনগর শাহী জামে মসজিদ হিসেবে পরিচিত। মূল নাম শাহীন খাঁ জামে মসজিদ হলেও বর্তমানে এটি বোকাইনগর শাহী জামে মসজিদ নামেই পরিচিত। সম্রাট শাহজাহান শাসনামলে আঞ্চলিক সেনাপতি শাহীন খাঁ বাহাদুর বোকাইনগরে একজন কেল্লা প্রধান বা কেল্লাদার ছিলেন। বোকাইনগরের ( ১৬২৮ – ১৬৫৮ )সতের শতকের দিকে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে প্রাচীন ভারতের কয়েকটি স্বনামধন্য পত্রিকায় তথ্য রয়েছে। যেমন- শত বছর আগে প্রকাশিত ‘ভারতী’ ( মাসিক পত্রিকা, কলকাতা), ‘জাহ্নবী’ ( মাসিক পত্রিকা, কলকাতা), সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদারের ‘সৌরভ’ ( মাসিক পত্রিকা, ময়মনসিংহ)। প্রাচীনকালের পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যগুলো ২০২০ সাল হতে ‘পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে এবং ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। তবে সঠিক ইতিহাসের পাতা আড়ালে থাকার কারণে মসজিদের সাল নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। বাংলা ১১০৫ সাল, সম্রাট আলমগীর আমলে মসজিদটি নির্মাণ করা হয় বলে বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে। উল্লেখ্য যে, মুঘল আমলের মসজিদে কোন বাংলা সন ও বাংলা অক্ষরের শিলালিপির তথ্য নেই। মসজিদের গায়ে থাকা শিলালিপিটি হারিয়ে যাওয়ার কারণে নির্মাণকাল সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য জানা যাচ্ছে না। ‘ভারতী’ পত্রিকায় মসজিদটির গায়ে থাকা শিলালিপি হারিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। যেমন “মসজিদটীর দ্বারদেশে অৰ্দ্ধচন্দ্রাকারে “লা এলাহা ইলাল্লাহ্, মহম্মেদো রসুল উল্লাহ……দরজমানে বাদশা সাজাহান” এই কথাগুলি পারস্য অক্ষরে ক্ষোদিত ছিল। বোকাইনগর বিজয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে কেল্লাদার শাহীন খাঁ তার নামে ১৬২৮-১৬৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এখানে নির্মাণ করেন ” শাহীন খাঁ জামে মসজিদ”।
শাহী মসজিদের উৎপত্তি ও নামকরণের ইতিবৃত্ত গবেষণা ও বিভিন্ন অনুসন্ধানী কাজ সম্পন্ন করেছে ময়মনসিংহের গৌরীপুরস্থ এসিক এসোসিয়েশন, ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি এন্ড লাইব্রেরি এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স। সরেজমিন ও গবেষণার মাধ্যমে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শেকড়সন্ধানী তথ্য ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হলো।
সম্রাট শাহজাহান আমলের শাহী মসজিদ ঃ
মসজিদটি গৌরীপুর উপজেলা শহরের চার-পাচঁ কিলোমিটার দক্ষিণে বোকাইনগর নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার দরগার কাছে অবস্থান করছে। মসজিদের সঙ্গেই অর্থাৎ পূর্ব দিকে এবং পশ্চিম দিকে দু’টি বিশাল পুকুর ছিল। বর্তমানে ধানক্ষেত ও কিছু জলাশয় রয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, এই মসজিদ চুন, সুরকি ও পাতলা বর্গাকার ইট দিয়ে নির্মিত। মসজিদের ভেতরের দৈর্ঘ্য ২৭ ফুটপ্রস্থ ১৭ ফুট। এর দেয়ালগুলো ৪২ ইঞ্চি ( তিন ফুট ৬ ইঞ্চি) পুরু বা চওড়া। মসজিদের ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে একটি মিহরাব রয়েছে। এক যুগ আগে মিহরাবটি বড় ও সংস্কার করতে শ্রমিকদের ২/৩ মাস সময় লেগেছিল। কেননা দেওয়ালগুলো অনেকটা পাথরের মত শক্ত। এ ছাড়া উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে ছোট ছোট দু’টি জানালা রয়েছে। মসজিদটিতে রয়েছে ২টি দরজা। দুই দরজার মাঝে রয়েছে আলোকবাতি রাখার স্থান । ১৮৯৭ সালের ১২ই জুন সংঘটিত হওয়া ভূমিকম্পের আগে মসজিদটির দেয়াল, কার্নিশ ও স্তম্ভে ফুল–লতাপাতাসহ ইটে অনেক অলংকরণ ছিল। আয়তাকার মসজিদটির ছাদের মধ্যস্থলে একটি বড় গম্বুজ এবং দুটি ছোট গম্বুজ দ্বারা আবৃত ছিল। গম্বুজ বিশিষ্ট টাওয়ার ছিল। এগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পর টিন দিয়ে ছাদ আচ্ছাদিত করা হয়েছিল। তখন মসজিদের উচ্চতা অনেকটা কমে যায়। বর্তমানে মসজিদটির ভিতরে ১০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট ছাদ রয়েছে। এরপর থেকে মসজিদটি তার জৌলুস হারিয়েছে। ঐতিহাসিক এই মসজিদে এখনো মুসল্লিরা নিয়মিত নামাজ আদায় করেন। মসজিদের ভেতরে ৪টি সারিতে ৫০ জন ও মসজিদের বাইরের চত্বরে ৪০ জন একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।
প্রাচীনকালের সচিত্রে শাহী মসজিদের বর্ণনাঃ
১৮৯৭’র ভূমিকম্পে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ বোকাইনগর শাহৗ মসজিদঃ
শাহী মসজিদটি মুঘল সম্রাট শাহজাহান আমলে (১৬২৮-১৬৫৮) নির্মিত বলে রামগোলাপুর জমিদার শৌরীন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ‘কেল্লা বোকাইনগর (সচিত্র)’ ফিচার থেকে শক্তিশালী ভূমিকম্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক মসজিদের দুই দরজার উপরে পারস্য অক্ষরে ক্ষোদিত শিলালিপির সূত্রে জানা যায় । ১৮৯৭ সালের ১২ই জুন আসামে সংঘটিত হওয়া ভূমিকম্পের প্রাবল্য ছিল ৮.৭ রিখটার স্কেল। তখন ইট-পাথর-সিমেন্টে নির্মিত অনেক অট্টালিকা মারাত্মকভাবে ধ্বংস হয়। ১৮৯৭’র ভূমিকম্পে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ শাহৗ মসজিদের মুঘল আমলের বাহ্যিক সৌন্দর্য একেবারে হারিয়ে ফেলেছে। তখন প্রতিটি ইটের মিনার ও গম্বুজগুলো ভেঙ্গে পড়েছিল। কিছু দেওয়াল ব্যতীত সবকিছু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। মসজিদটির মুঘল আমলের দেওয়াল যেন আজও ১৮৯৭’র ভূমিকম্পের প্রতিফলন সাক্ষ্য দিচ্ছে। জমিদার শ্রীশৌরীন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর লেখা থেকে মসজিদ সম্বন্ধে তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হলো- মসজিদটী বহুকাল দণ্ডায়মান থাকিয়া বিগত ১৩০৪ সালের ভীষণ ভূমিকম্পে পার্শ্বের একটী দেওয়াল ব্যতীত সমস্তই ভূমিসাৎ হইয়াছে। প্রাচীন ইষ্টক গুলি অতীব দৃঢ় ৷ দেওয়ালের বহির্দ্দেশে ইষ্টক গুলির গাত্রে এক প্রকার প্ৰলেপ আছে। ইহা ঠিক চীনে মাটীর প্রলেপের মত দেখা যায়। বোধ হয় – ইহাই কোন স্থানের আস্তর ছিল। এইরূপ সুন্দর ইট ২।১ খানি ময়মনসিংহের সাহিত্য পরিষদে প্রদর্শিত হইয়াছিল। মসজিদটীর দ্বারদেশে অৰ্দ্ধচন্দ্রাকারে “লা এলাহা ইলাল্লাহ্, মহম্মেদো রসুলউল্লাহ…… ..দরজমানে বাদশা সাজাহান” এই কথাগুলি পারস্য অক্ষরে ক্ষোদিত ছিল। অধিবাসীগণ প্রাচীন কীৰ্ত্তি রক্ষা করিবার জন্য অর্থ সংগ্রহপূর্ব্বক কতক দূর সংস্কৃত করেন। কিন্তু বর্ষার প্রাবল্যে নুতন নিৰ্ম্মিত স্থান পুনরায় ধ্বংস প্রাপ্ত হইয়াছে। বর্ত্তমানে একটী প্রাচীন দেওয়াল ও কতকগুলি ইষ্টক স্তূপ মাত্র রহিয়াছে।” উদ্ধৃতি ব্যাখ্যা করলে বোঝা যায় যে, সম্রাট শাহজাহান আমলের শাহী মসজিদের কারুকার্য ইট খুবই মূল্যবান ও কাচেঁর ন্যায় স্বচ্ছ সিরামিক ছিল। দর্শনার্থীদের দেখানোর জন্য ময়মনসিংহের সাহিত্য পরিষদে ১/২টা ইট রাখা হয়েছিল।
বোকাইনগর শাহী মসজিদে রয়েছে তিন ব্যক্তির স্মৃতিচিহৃঃ
শাহী মসজিদের নীরব স্থানে জিনের চলাচলঃ
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত করার দাবীঃ
প্রাচীন মসজিদগুলোর দিকে বেশি নজর দেয়া দরকার। মুসলিম স্থাপত্যের এ নিদর্শন সরকারের একটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত এবং তত্ত্বাবধানে রাখার দাবী করছে সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় আসার পর মসজিদের সংস্কারকাজ খুব সহজ হবে। দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স এর ইলেক্টরগণ মনে করেন মুঘল কারুকার্য ও স্থাপত্যশৈলী অনুসরণ করে মসজিদটির বর্তমান ছাদ ভেঙ্গে পুনরায় তিনটি ছোট বড় গম্বুজ তৈরী করলে মসজিদের বাহ্যিক সৌন্দয্য ফিরে আসতে পারে। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই এই মসজিদ জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। প্রচণ্ড গরম আবহাওয়া থাকলেও শাহীন খাঁর প্রাচীনতম মসজিদের ভেতরটা বেশ ঠান্ডা থাকে। নামাজ আদায় করে বেশ প্রশান্তি পাওয়া যায়।
মসজিদের আয়তক্ষেত্রের ধরণ ও কারুকার্য দেখে ভারতের বিভিন্ন স্থানে মুঘল আমলের মসজিদের এই আদলে সাদৃশ্য বা প্রতিচ্ছবি থাকতে পারে। তাছাড়া বড় জামাতের জন্য মসজিদের সামনে একটি ঘর বা আলাদা মসজিদ নির্মাণ করা যেতে পারে। মসজিদের ইমাম মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ঐতিহাসিক মসজিদ হওয়ায় এখানে বিভিন্ন এলাকা ও দেশের বাইরে থেকে পর্যটক প্রায়ই আসে।
পরিশেষে
১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মসজিদের গম্বুজগুলো ভেঙ্গে পড়লে ধ্বংস হওয়া মসজিদটি গম্বুজগুলো পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। তাছাড়া এ এলাকার ধর্মপ্রাণ মানুষগুলোর আবেগও এই স্থাপনাগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে। তাই প্রয়োজন সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের। সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত মসজিদগুলোর দিকে বেশি নজর দেয়া দরকার।
সরকারী সাহায্য সহযোগীতা নিয়ে মসজিদটি সংস্কার হলে আরও চিত্তাকর্ষক হবে।